সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাঃ সরকার বলছে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এখন ৭.৬৫ শতাংশ। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি যায় কোথায়? সিপিডি বলছে, গত অর্থবছরে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। এক বছরে গড়ে মানুষের আয় কমেছে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ। দ্বিতীয়ত, পুরুষের চেয়ে নারীদের আয় বেশি কমেছে। তৃতীয়ত, শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের আয় আরও কমেছে। চতুর্থ, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। সবশেষে আয়ের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য বেড়েছে। খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটের মানুষের আয় বেশি কমেছে। এর মানে হলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসংক্রান্ত সরকারের তথ্য সঠিক হলে ওই কর্মসংস্থান অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে হয়েছে। সেখানে আয় কম, শ্রমের অধিকার বা পরিবেশ নেই। অর্থাৎ দেশে আয়বিহীন কর্মসংস্থান হচ্ছে।
সিপিডির বক্তব্যের ব্যাখ্যা সরকার নিশ্চয়ই দিবে। অনেকদিন ধরে বেশ কিছু বিষয় উদযাপিত হচ্ছে। আমরা আনন্দ করেছি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ায়, করেছি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল হওয়ায়। জোর গলায় বলছি প্রবৃদ্ধির কথা, উন্নয়নের কথা। আমরা বিপুল খরচ করছি অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান কেনায়, আধুনিক সামরিক বাহিনী গঠনে, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে, বড় সেতু আর রাস্তা তৈরিতে।
‘কর্মসংস্থান বাড়বে কতটুকু তা এক বড় প্রশ্ন। আমাদের শিল্প আর সেবায় ১৭ শতাংশ বড় বেতনের কাজ করে বিদেশিরা। কারণ আমরা কেবল স্নাতক আর স্নাতকোত্তরের সংখ্যা বাড়াচ্ছি, দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করছিনা।’
কিন্তু এই যে এত উন্নতি, প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক বড় অর্থনীতির বাসিন্দা হতে গিয়ে কেমন আছি আমরা? একটা সরকারি চাকরির জন্য তারুণ্যের মরিয়া আন্দোলন প্রমাণ করে আমরা খুব ভাল নেই। দেশের মানুষ কতটা ভাল থাকবেন, তা প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে না, করেনা মাথাপিছু কত টাকা আয় করছে তার ওপরও। জিডিপি বাড়তেই থাকবে, মাথাপিছু আয়ও বাড়বে। কারণ এসবই গড় হিসেব। জিডিপি-র হিসেবের বাইরেও কিছু থেকে যায়। বস্তুত, সেগুলোই বেশি জরুরি। উন্নয়নের পথে ধরে এগুচ্ছে অনেক, পিছিয়ে পড়ছে বা তলানিতেও চলে যাচ্ছে বহু। এই তলানির মানুষের বড় অংশ নিরক্ষর থাকছে, থাকার মতো বাড়ি নেই, তাদের স্যানিটেশন নেই, তারা কেবল জীবন ধারণ করে চলে।
বাণিজ্যক্ষেত্রে কাজ করতে যত শ্রমিক দরকার হয়, আগামীতে তার চেয়ে অনেক কম সংখ্যক শ্রমিক সেই কাজ করবে। অটোমেশনের কারণে শিল্পে কম কর্মী লাগতে শুরু করেছে। আবার যাদের লাগছে তাদের হতে হচ্ছে বেশ খানিকটা দক্ষ আমাদের অর্থনীতির বড় অংশ জুড়ে সেবাখাতের উপস্থিতি। সেখাতে যথেষ্ট লেখাপড়া আর প্রশিক্ষণ জরুরি বিষয়। ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে কতটুকু তা এক বড় প্রশ্ন। আমাদের শিল্প আর সেবায় ১৭ শতাংশ বড় বেতনের কাজ করে বিদেশিরা। কারণ আমরা কেবল স্নাতক আর স্নাতকোত্তরের সংখ্যা বাড়াচ্ছি, দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করছিনা।
সরকার প্রবৃদ্ধির কথা বলেছে। এই পুরো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ প্রায় স্থবির হয়ে আছে। সিপিডি বলছে, বিনিয়োগ স্থবির থাকলেও বেসরকারি খাতের ঋণ বাড়ছে। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এক্ষেত্রে আমদানির আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন করছে সিপিডি।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব অনেক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, তিনি এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা চান যাতে দরিদ্র মানুষ অন্তত অভুক্ত না থাকে। কিন্তু কাজটি চ্যালেঞ্জিং। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাপনায় রেন্ট সিকিং কালচারের প্রাধান্য অনেক বেশি। রাষ্ট্র দরিদ্র মানুষের জন্য যে উদ্যোগই নিকনা কেন, দালাল আর ফড়িয়ারা লাভের গুড় খায়। দশ টাকা কেজি দরিদ্র বান্ধব কর্মসূচি ভেস্তে দিয়েছে এই শ্রেণি। যার ওপর নির্ভর করা হয়, সে ভক্ষক হয়ে যায়।
মাথাপিছু আয়, জাতীয় আয় বাড়ার পরও কেন মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেলো তার চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আমাদের কোন ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম নেই যার মাধ্যমে দেশের সব মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থান জানা সম্ভব হবে। আমাদের এমন কোন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি যে মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণিকে এড়িয়ে সরাসরি গরিব মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যাবে।
দারিদ্র্য কমেছে। তবুও দরিদ্র আছে। একটি দেশের সমৃদ্ধি নির্ভর করে তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর, রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষমতার ওপর। কিন্তু সেই রাজস্ব কীভাবে বণ্টিত হবে, সেটাও জরুরি প্রশ্ন। এ দেশে যাদের সরকারি ভর্তুকি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের মধ্যেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বাধিক।
আমাদের সব প্রচেষ্টা সত্বেও জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার প্রসার হলে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিজে থেকেই কমে যাবে বলে যে আশা ছিল, তা হয়নি। জনতাকে শক্তিতে পরিণত করার কথা যত কথাই বলুকনা কেন বিজ্ঞজনেরা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বড় প্রচার আবার আরম্ভ করতে হবে।
সমস্যা আমাদের অনেক। বড় সমস্যা অবকাঠামো। গাড়ি চলার মতো রাস্তা নেই, যথেষ্ট বিদ্যুৎ নেই। সরকার এগুচ্ছে, বড় প্রকল্প করছে, কিন্তু তবুও যেন অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছেনা। দেশের প্রধান শহরগুলিতে জনসংখ্যা বাড়ছে। গ্রাম থেকে মানুষ সুযোগের সন্ধানে শহরে আসছে। এই সমস্যা সামাল দেওয়ার একটাই উপায় উপশহর গড়ে তোলা। তার জন্য দ্রুত গতির গণ পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে বলছি, কিন্তু করছিনা।
সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের উন্নয়নের দায়িত্বটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে বাড়তি রাজস্ব জোগাড় করতে হবে। যারা যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও করের আওতার বাইরে, তাদের করের আওতায় এনে এই বাড়তি রাজস্বের একটি অংশ জোগাড় করা যেতেই পারে। কিন্তু, শুধু সেটুকুতেই চলবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের মাধ্যমেও অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হবে। ব্যবসা সরকারের কাজ নয়, তাই শিল্প বা সেবা যে ব্যবসাই থাকুক, সরকার তা ছেড়ে দিক।
এই কাজগুলো ঠিকভাবে করলে জিডিপি, মাথাপিছু আয় নিজে থেকেই উন্নত হবে, কর্মসংস্থান হবে, অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য আসবে।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ