খবর২ ৪ঘণ্টা, ডেস্ক: বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) ডা. আবদুল কাদের খানসহ সাতজনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ দিলীপ কুমার ভৌমিক এ রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন- ডা. আবদুল কাদের খানের একান্ত সহকারী মো. শামছুজ্জোহা, তার গাড়িচালক আবদুল হান্নান, মেহেদি হাসান, শাহীন মিয়া, আনোয়ারুল ইসলাম ও চন্দন কুমার রায়। রায় ঘোষণার সময় পলাতক চন্দন কুমার ছাড়া সব আসামিই কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া মামলার এক আসামি কসাই সুবল চন্দ্র রায় কারাগারে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।
এর আগে বেলা ১১টা ২০মিনিটের দিকে গাইবান্ধা জেলা কারাগার থেকে কঠোর নিরাপত্তায় হত্যা ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থ যোগানদাতা হিসাবে অভিযুক্ত জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) ডা. আব্দুল কাদের খানসহ অভিযুক্ত আটজন আসামির মধ্যে ছয়জনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে রায় ঘোষণা শেষে বেলা ১২টার দিকে আবারো পুনরায় তাদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে আদালত থেকে জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ওই আদালতের পিপি শফিকুল ইসলাম বলেন, এরআগে তদন্ত শেষে এই হত্যা মামলায় কাদের খানসহ আটজনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। “২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত বাদী, নিহতের স্ত্রী ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৫৯ জনের ২২ কার্য দিবসে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত।”
গত ৩১ অক্টোবর মামলার সাক্ষী গ্রহণ কার্যক্রম শেষ হয়। এছাড়া ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। পরে পর্যায়ক্রমে কারাগারে থাকা আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানি হয়। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের দীর্ঘ ১৮ মাস যুক্তিতর্ক শেষ হয় গত মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর)।
তিনি আরও জানান, দ্রুত এই রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে এই রকম একটি জঘন্য ঘটনার কলঙ্ক মুক্ত হতে চায় সুন্দরগঞ্জবাসী।
তিনি বলেন, প্রধান আসামি সাবেক এমপি জাতীয় পার্টির অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডাঃ আব্দুল কাদের খানকে একই ঘটনায় অস্ত্র মামলার রায়ে গত ১১ জুন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন এই বিচারক। এছাড়া অস্ত্র মামলায় পৃথক এক ধারায় তাকে ১৫ বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। লিটন হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত তিনটি অস্ত্রের মধ্যে একটি অস্ত্র কাদের খান নিজে সুন্দরগঞ্জ থানায় জমা দেন। একটি অস্ত্র ৬ রাউন্ড গুলিসহ কাদের খানের স্বীকারোক্তি মোতাবেক তার নিজ বাড়ির উঠান থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তবে অপর অস্ত্রটির সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
এদিকে, আসামি কর্নেল ডাঃ আব্দুল কাদের খানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মঞ্জুর মোর্শেদ বাবু বলেন, এই মামলার রায়ে তারা অসন্তোষ ও হতাশ। তিনি আরও বলেন, ন্যায় বিচারের আশা করা হয়েছিল, কিন্তু এই বিচারে তারা ন্যায় বিচার পাননি। তাই এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন।
তিনি আরও জানান, অন্য ৬ আসামিরা গরীব, তাই তারা জেল আপিল করবে।
যেভাবে সংঘটিত হত্যা: লিটন বিগত ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের সাহাবাজ গ্রামের মাস্টারপাড়ার নিজ বাড়ির বৈঠকখানার সোফায় বসেছিলেন। এ সময় সন্ধ্যা পাঁচটা ৪০ মিনিটের দিকে একটি মোটরসাইকেলে অজ্ঞাত তিন যুবক সেখানে আসে। আততায়ীদের সবার মাথায় হেলমেট ছিল। এদের মধ্যে একজন মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অপর দুইজন বৈঠকখানায় ঢুকে এমপি লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে। এমপি গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। এসময় ঘরের মধ্যে থাকা অন্যরা ছোটাছুটি করে বেরিয়ে যায়। দুর্বৃত্তরা দ্রুত মোটরসাইকেল যোগে পালিয়ে যায়। পরে গুলিবিদ্ধ এমপিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে সাতটার দিকে তিনি মারা যান।
লিটন হত্যা মিশনে তিনজন হত্যাকারী অংশ নেয়: হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান রিকশাচালক মেহেদি হাসানকে শাহীন মিয়া প্রলোভন দিয়ে এই চক্রে যুক্ত করেন। কাদের এই কিলারদেরকে এ পর্যন্ত ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। এমপি হওয়ার পর তাদেরকে গাড়ী-বাড়িসহ আরো অনেক কিছু করে দেওয়ার প্রলোভন দেখান। শুধু তাই নয় জামায়াত অধ্যুষিত সুন্দরগঞ্জের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটাতে কর্নেল কাদের তার লোক দিয়ে এক বছর থেকে ছিনতাই, মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর, অপহরণসহ একের পর এক নানা অপকর্ম ঘটান। যাতে এমপি লিটন হত্যার দায় তাদের উপর গিয়ে পরে। এবং সুযোগ খুঁজতে থাকেন এমপি লিটনকে গুলি করে হত্যা করার সেই কলংকজনক একটি অধ্যায়ের মূহুর্ত। সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এমপি লিটনের নিজ বাড়িতে তাকে গুলি করে হত্যা করতে সক্ষম হয় কিলাররা।
পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত ৩ খুনি ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে খুনের ঘটনা স্বীকার করে এবং এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারি, অর্থ যোগানদাতা ও প্রশিক্ষণদাতা হিসেবেও আব্দুল কাদের খানের নাম উল্লেখ করে।
মামলা দায়ের: পরেরদিন এ ঘটনায় লিটনের বড় বোন ফাহমিদা কাকলী বুলবুল বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
যেভাবে এই হত্যার রহস্য বের হয়: দীর্ঘ এক বছরের পরিকল্পনায় ঠাণ্ডা মাথায় ক্লুলেস করে কর্নেল (অবঃ) ডা. আব্দুল কাদের খান হত্যা করেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসনের সরকার দলীয় এমপি লিটনকে। পেশাদার খুনি ভাড়া না করে হতদরিদ্র ঘরের তিন যুবককে প্রলোভনে জালে আটকিয়ে নিজেই তাদেরকে ৬ মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে তার কিলিং মিশন সফল করেন। যাতে কেউ ভাবতে না পারে হতদরিদ্র এই তিন যুবক এমপি লিটনকে খুন করেছে।
জেএন