ঢাকাসোমবার , ৪ মার্চ ২০১৯
আজকের সর্বশেষ সবখবর

নিয়ন্ত্রণহীন অবৈধ ভিওআইপি সরকার হারাচ্ছে ২৫০০ কোটি টাকা: পাচার হচ্ছে ৭০০ কোটি

অনলাইন ভার্সন
মার্চ ৪, ২০১৯ ১২:০৯ অপরাহ্ণ
Link Copied!

খবর২৪ঘণ্টা,ডেস্ক: বৈধপথে আন্তর্জাতিক কল বাড়াতে কমানো হয়েছে ইনকামিং কল টার্মিনেশন রেট। অবৈধ কল টার্মিনেশনে অনিবন্ধিত সিম ব্যবহার হচ্ছে জানিয়ে বায়োমেট্রিক (আঙুলের ছাপ দিয়ে) সিম নিবন্ধন চালু করেছে সরকার। অবৈধপথে কল আদানপ্রদানের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে দু’একটি অভিযানও চালাচ্ছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি) ও র‌্যাবের যৌথ টিম। তবে কোন কিছুই যেন কাজে আসছে না।

বৈধপথের সাথে পাল্লা দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) কল। অবৈধ এই ব্যবসার জন্য প্রতিবছর বিদেশে পাচার হচ্ছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। আর সরকার হারাচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। খোদ বিটিআরসি’র তথ্য অনুযায়ি প্রতিদিন আড়াই কোটি মিনিট কল অবৈধ পথে আসছে। বিটিআরসির দেয়া তথ্যে এই হিসেব হলেও বাস্তবে এই পরিমাণ আরও বেশি। তিন বছর আগেও যেখানে অবৈধ ভিওআইপির পাশাপাশি বছরে আন্তর্জাতিক কল থেকে সরকারের রাজস্ব এসেছে ২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। সেখানে গত অর্থবছরে এটি নেমে এসেছে অর্ধেকেরও কমে।

এই বছরে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৯০৫ কোটি টাকা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ ভিওআইপির ফলে একদিকে যেমন সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈধ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা পরিচালনাকারী ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইআইজি) অপারেটররা। অবৈধ ভিওআইপি বন্ধে বিটিআরসি’র ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। তারা দু’একটি অভিযান পরিচালনা, কয়েকজনকে গ্রেফতার, কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করেই দায়িত্ব শেষ মনে করে। এই ব্যবসার সাথে জড়িত রাঘব-

বোয়ালদের বিষয়ে কখনই কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে। বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেছেন, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দুটো বড় অভিযানের পর পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ্যণীয় নয়। এখানে অনেকেরই গাফলতি আছে বলে আমরা মনে করি। বিটিআরসির মহাপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মোস্তফা কামাল বলেছেন, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়িরা দৈনিক মাত্র এক লাখ সিম ব্যবহার করলেও বছরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম ৯ বছরে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭৪৪ কোটি ২১ লাখ ১২ হাজার ১০২ টাকা। তবে এই খাত থেকে এখন প্রতিনিয়ত আয় কমছে। সর্বশেষ অর্থবছরে মাত্র ৯০৮ কোটি টাকা রাজস্ব এসেছে। বৈধপথে আন্তর্জাতিক কল ও রাজস্ব বাড়াতে সরকার কী ধরণের উদ্যোগ নিচ্ছে এমন প্রশ্নে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল টার্মিনেশন রেট এক দশমিক ৭৫ থেকে দুই দশমিক ৫০ সেন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলার ২৬টি স্থাপনায় অভিযান চালিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ও র‌্যাব। অবৈধ ভিওআইপি অভিযানে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের ৪২ হাজার ১৫০টি সিম ও প্রায় ১ কোটি ২৩ লক্ষাধিক টাকা মূল্যমানের অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে অবৈধ ভিওআইপির অভিযোগে রাষ্ট্রায়াত্ত¡ মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের ৭৭ হাজার ৫৯০টি সিম বন্ধ করে দেয় বিটিআরসি। অবৈধ ভিওআইপি অভিযানের অংশ হিসেবে সিডিআর এনালাইজার এবং জিও-লোকেশন ডিটেকশন সিস্টেমের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহারের অপরাধে টেলিটকের ৭৭ হাজার ৫৯০টি শনাক্ত হয় এবং বন্ধ করে দেয়া হয়।

কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন প্রতিরোধে চলমান অভিযানের অংশ হিসাবে সিডিআর এনালাইজের মাধ্যমে গত ১৮ নভেম্বর টেলিটকের ৩৩ হাজার ৫৩৪টি সিম অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশনে ব্যবহৃত হওয়ায় সনাক্ত করা হয় এবং গত ১১ অক্টোবর একই কারনে টেলিটকের ৪৪ হাজার ৫৬টি সিম বন্ধ করা হয়।
বিটিআরসির কমিশনার রেজাউল কাদের বলছেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগের দিন ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ থেকে পরবর্তী তিন দিন হাইস্পিড মোবাইল ব্রডব্যান্ডের (থ্রিজি/ফোর জি) গতি কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওই সময় দেশে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল গড়ে প্রায় ১০০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এ বৃদ্ধির কিছু অংশ গ্রাহকরা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কল করতে না পারায় হয়েছে; তবে সিংহভাগই বেড়েছে অবৈধ ভিওআইপি না হওয়ায়।

এদিকে অবৈধ ভিওআইপির বিরুদ্ধে বিটিআরসি ও র‌্যাবের প্রতিটি অভিযানেই মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর বিপুল পরিমাণ সিম জব্দ করা হয়। খাত সংশ্লিষ্টরা অপারেটরদের বিষয়ে বলেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর এখন বায়োমেট্রিক ছাড়া সিম বিক্রি হওয়ার কথা নয়। তাহলে প্রতিটি অভিযানে যে এতো বিপুল সংখ্যক সিম জব্দ করা হয়, এসব সিম কিভাবে অবৈধ ব্যবসায়িদের কাছে যায়? ২০১৮ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে পরিচালিত দুটি অভিযানে দেখা গেছে, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় দেশের মোবাইল অপারেটরদের সিম ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

অভিযানে পাওয়া প্রায় ৫৩ হাজার সিমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে টেলিটক ও রবি’র সিম। এই দুটি অপারেটরের যথাক্রমে ২১ হাজার ১৮টি এবং ২০ হাজার ৭০৯টি সিম পাওয়া গেছে। বাংলালিংক ও গ্রামীণ ফোনের পাওয়া গেছে যথাক্রমে ৬ হাজার ৬০২টি এবং ৪ হাজার ৬৪৭টি সিম। আর মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুয়ায়ি, ২০১৭-১৮ বছরে ২৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে বিটিআরসি ও র‌্যাব। এসব অভিযানে ১৫ হাজার ৪৭৬টি সিম জব্দ করা হয়েছে ও ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৩১৮টি সিম বন্ধ করা হয়েছে।

অভিযান দুটি’র পর বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, সিম বিক্রির পর কোথায় তা ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি লক্ষ্য রাখার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে মোবাইল ফোন অপারেটরদের। এজন্য তাদের বিটিআরসি’র কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ সকল ব্যর্থতার জন্য অপারেটরদের টেলিযোগাযোগ আইন ও অর্থপাচার আইনের সম্মুখীন হতে হবে বলে উল্লেখ করেন বিটিআরসির মহাপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোস্তফা কামাল।

এ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ক্ষোভের সাথে জানান, প্রতিটি অভিযানে বেশকয়েক জনকে গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে কিছু দিনপর তারা আবারও বেরিয়ে এসে একই ব্যবসায় জড়িত হয়। কিন্তু অবৈধ ভিওআইপির আড়ালে যেসব রাঘব-বোয়াল আছে তারা সব সময় ধরাছোয়ার বাইরেই থাকছে। প্রকৃতপক্ষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে তেমন কোন কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয় না। তারা আরও বলেন,

সম্প্রতি সরকার-ঘোষিত অভ্যন্তরীণ মোবাইল কল রেট সর্বনিম্ন প্রতি মিনিট ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আন্তঃগামী কল রেটের যে হিস্যা মোবাইল অপারেটররা পায় তার মূল্য প্রতি মিনিট প্রায় ৩৩ পয়সা। এতে আন্তর্জাতিক আন্তঃগামী কলের চেয়ে অভ্যন্তরীণ কলের আড়ালে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে দেশের অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা আরো বেগবান হচ্ছে।

অবৈধ ভিওআইপিতে জড়িত থাকায় অপারেটরগুলোর বিরুদ্ধে কী ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ভিওআইপি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকা টেলিকম কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে জরিমানা বাবদ ৮৬০ কোটি ৬০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জরিমানা করা হয়েছে গ্রামীণফোনকে। এই অপারেটরটিকে জরিমানা করা হয়েছে ৪১৮ কোটি ৪০ লাখ, রবি আজিয়াটাকে ১৪৫ কোটি, বাংলালিংকে ১২৫ কোটি, র‌্যাংকস টেলিকমকে ১৫০ কোটি, পিপলস টেলিকমকে ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় অবৈধ ভিওআইপিতে শীর্ষে থাকা রাষ্ট্রীয় টেলিকম অপারেটর টেলিটককে জরিমানার কথা বলা হয়নি।

খবর ২৪ঘণ্টা/ জেএন

বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।