খবর২৪ঘণ্টা.কম, ডেস্ক: জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আড্ডায় এক সুহৃদ জানালেন, ‘সরকারের কাছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা নেই।’ সুহৃদের এ তথ্য জেনে আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইনি। মনে করেছি, তিনি বোধ হয় না জেনে কথাটা বলছেন। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো এ নিয়ে একটু খোঁজ নিই না কেন। খোঁজ নিয়ে দেখি, আসলেই সরকারের কাছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা নেই।
একাত্তরে কতজন বুদ্ধিজীবীকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা হত্যা করেছিল, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে- এটা জেনে সত্যি দুঃখ হলো। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ ব্যাপারে সংসদে প্রশ্ন করা হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক তালিকা তার মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত নেই। তবে সঠিক তালিকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তখন আগামী জুনের মধ্যে এই তালিকা প্রকাশের আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন মোজাম্মেল হক। সেই আশাবাদ ব্যক্ত করার পর চলে গেছে তিন বছর। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে জানা গেছে, এখনো এ তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
একাত্তরের নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ডিসেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের দুদিন আগে একসঙ্গে অনেককে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের স্মরণে ১৪ ডিসেম্বর দিনটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকার কারণ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, বুদ্ধিজীবীদের ‘সঠিক সংজ্ঞা’ না থাকায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি সম্ভব হচ্ছে না। তবে তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ঢাকা কেন্দ্রিক কিছু শহীদ বুদ্ধিজীবীর প্রাথমিক তালিকা আছে। সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও কিছু নামের তালিকা তারা পেয়েছেনে বলে জানান মন্ত্রী।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কোনো তালিকা নেই। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, আলাদা করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা নেই। তবে এ বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে। যেমন শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী ও সাংবাদিকদের আলাদা তালিকা রয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংজ্ঞা না থাকায় এ তালিকা তৈরি করা কিছুটা কঠিন।
মফিদুল হক বলেন, হয়তো একজন শিক্ষক নিহত হয়েছিলেন, তাকে সেভাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই এই তালিকা করা কিছুটা কঠিন। একজনের তো ‘ডুয়েল আইডেনটিটি’ও (দ্বৈত পরিচয়) থাকে। তবে শহীদ বৃদ্ধিজীবীদের নিয়ে কাজটা হওয়া উচিত।
এ সম্পর্কে যারা জানেন তাদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, ১৯৭২ সালে সাড়ে ৩০০ শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা করা হয়েছিল। কিন্তু তাও ছিল অসমাপ্ত। পরবর্তী সময়ে এ তালিকাকে চূড়ান্ত রূপ আর দেয়া হয়নি। পরে ১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক গ্রন্থ’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৫ সালে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহের জন্য তখন বাংলা একাডেমি সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সে সময় প্রতিষ্ঠানটি নিজেরাই ঠিক করে যে শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, প্রকাশকসহ বিশেষ কিছু পেশাজীবীকে ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
সেই নীতিমালা অনুযায়ী ১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২৫০ জনের তালিকা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। যে ২৫০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করা হয় তাদের অনেকেরই আবাসিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে সংগৃহীত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেরই বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কোষগ্রন্থের নাম-ঠিকানা ধরে খোঁজখবর নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বেশ কয়েকজনের নিকটাত্মীয়ের লেখা নিয়ে ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে ‘স্মৃতি-৭১’ গ্রন্থ।
গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং কোষগ্রন্থে প্রকাশিত তালিকার বাইরে অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়স্বজন তাদের তথ্য নিয়ে বাংলা একাডেমির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ পর্যায়ে এসে কোষগ্রন্থের তালিকাসহ মোট প্রায় ৩২৫ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম বাংলা একাডেমির হাতে আসে। পরে একের পর এক ‘স্মৃতি-৭১’ প্রকাশিত হতে থাকে। এ গ্রন্থের ১০ম খ- প্রকাশিত হয় ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ১০ম খ-ে স্থান পেয়েছে ১২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নিকটাত্মীয়ের স্মৃতিকথা। এর বাইরে বাংলা একাডেমি আর কোনো তালিকা সংগ্রহ বা প্রকাশ করতে পারেনি।
অন্যদিকে ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একাত্তরের ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলি এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনামতো হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। কারণ ফরমান আলির টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউসে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে মেরে ফেলা।
স্বাধীনতা অর্জনের পর ইতোমধ্যে কেটে গেছে ৪৬ বছর। এই সময়ের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ‘সঠিক সংজ্ঞা’ নিরূপণ না হওয়াটা দুঃখজনক। এ জন্য বিজয়ের ঊষালগ্নে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের তালিকা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। ফলে সে সময় জাতি কতজন মেধাবী সন্তানকে হারিয়েছিল তা এবং তাদের ইতিহাস অজানাই থেকে যাচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজর কাছে। ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা মনে করেন, সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণ করে এ তালিকা শিগগিরই প্রণয়ন করা হোক।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/রখ