তুষার আবদুল্লাহঃ আমরা যারা ঢাকা মহানগরীতে থাকি, তাদের নগরে টিকে থাকতে রকমারি ছলাকলার আশ্রয় নিতে হয়। বলা যায় আমাদের জীবনটাই হয়ে উঠেছে ছলাকলার। বাড়ি থেকে অফিস বা কোন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হবো, তার আগে পথের রুপ ঢঙ কি হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় বুক কাঁপে।
আমি, আমরা যেমন পথকে জানিনা। পথও কি নিজেকে জানে ষোলআনা? কখন কি কারণে তার উপর যানবাহনের আফাল বা ঢেউ আছড়ে পড়বে সেই কথা পথও ঠাওর করে উঠতে পারেনা অনেক সময়। মহানগরে কতোজন অতি বিশিষ্ট, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বসবাস করেন সেই হিসেবও পথের মস্তিস্কে নেই।
‘পথের মনস্তত্ত্ব আছে বলে জানতাম। এক পথে নিয়মিত যাতায়াত করলে বুঝে ফেলা যায়, ঐ পথ দিনের কখন কতো সময় পেরোনো যাবে। এখন পথ সেই মনস্তত্ত্বের বাইরে চলে গেছে। পথচারীদের সঙ্গে সত্যিই পথের তৈরি হয়ে গেছে দূরত্ব। এই দূরত্ব তৈরি করেছে পথের পরিচালকরা। ’
নতুন কারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন, সেই খবরও সময় মতো তার কাছে পৌঁছেনা। আচমকা নব্য গুরুত্বপূর্ণরা পথের উপর চড়াও হন। পথকে মুখ বুঁজে সেটা সইয়ে যেতে হয়। পথের উপর চাপ কমানোর বা ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্বে যারা, তারা সাম্যতা ভুলে বসে আছেন। তাদের পক্ষপাতিত্ব বিশিষ্টদের দিকে। তাই পথ না চাইলেও দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা এবং যন্ত্রণায় পীড়িত হতে হয় নগরের আম মানুষদের। পথ ইচ্ছে করলেই আম মানুষকে ছাড় দিতে পারেনা। পথ কতো অসহায় ভাবুন।
দিন তিনেক আগে হাতিরঝিল পার হবার সময় মনে হলো আজ সার্কফোয়ারার দিকের পথ ব্যবহার করি। আগেই বলেছি ছলাকলা করে পথ চলতে হয়। একেক দিন একেক পথ। হাতিরঝিল সিগন্যাল সহজেই পেরিয়ে গেলাম। এমনকি এফডিসির রেলগেইটও। পেট্রোবাংলা পেরিয়ে সোনারগাঁওর প্রস্থান গেইটের সামনে গিয়ে আটকা পড়ে গেলাম। লোহার দন্ড এসে পথ আটকালো। ভাবলাম মিনিট পাঁচেকের ব্যাপার, বড় জোর দশ মিনিট।
সিগন্যাল ছাড়লেতো আমিই সবার আগে। আমার চোখকে সাক্ষী রেখে সোনারগাঁও হোটেলের প্রস্থান গেইট দিয়ে কতো গাড়ি যে বেরিয়ে গেলো, গুনে রাখতে পারিনি। সিগন্যাল ফেলে ট্রাফিক পুলিশও লাপাত্তা। এদিকে সার্কফোয়ারার সবদিকের সিগন্যালই ছাড়া হচ্ছে, কেবল সোনারগাঁও দিককারটি ছাড়া।
অ্যাম্বুলেন্স, দমকলের গাড়ি, সেনাবাহিনীর গাড়ি হর্ন বাজিয়ে হা পিত্যেস করছে। কিন্তু চত্ত্বরে দাঁড়ানো ট্রাফিক পরিদর্শক উত্তরদিকের সিগন্যাল খুলে রেখেছেন উদার ভাবে। উত্তর দিক থেকে আসা গাড়ির প্রবাহ কমে এলেও তিনি পূর্বদিকের প্রতি সদয় হচ্ছেন না।
আধ ঘণ্টা পর একজন ট্রাফিক পুলিশের কাছে জানতে চাইলাম, অতি গুরুত্বপূর্ণ কেউ কি উত্তর দিক থেকে আসছেন? তিনি নাবোধক উত্তর দেন। বললাম তাহলে ছাড়ছেন না কেন? বললেন সবই নাকি ঐ পরিদর্শক এবং ট্রাফিক সার্জেন্টের মর্জির উপর। গাড়ি থেকে নেমে দুই একজন ঐ পরিদর্শক ও সার্জেন্টের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি সাড়া দিলেন না।
চল্লিশ মিনিটের দিকে একজন আনসার সদস্য এসে লৌহদন্ড আলগা করে এক দুইটি গাড়িকে বের করে দিতে থাকেন অন্য দিকে তাকিয়ে। হয়তো তা দেখেই হুঁশে ফেরেন পরিদর্শক মহোদয়। মুক্তি ঘটে আমার। তবে সবুজ সংকেতের আয়ু কম থাকায়, হাতিরঝিল পেরিয়ে প্রায় রামপুরা ছুঁয়ে ফেলা বাহনের দীর্ঘ লাইনের কখন মুক্তি ঘটেছিল জানতে পারিনি। তবে শহরের নানা সিগন্যালে আটকে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিত করেই বলতে পারি ঘণ্টা তিনেকের আগে তারা মুক্তির দেখা পায়নি।
পথের মনস্তত্ত্ব আছে বলে জানতাম। এক পথে নিয়মিত যাতায়াত করলে বুঝে ফেলা যায়, ঐ পথ দিনের কখন কতো সময় পেরোনো যাবে। এখন পথ সেই মনস্তত্ত্বের বাইরে চলে গেছে। পথচারীদের সঙ্গে সত্যিই পথের তৈরি হয়ে গেছে দূরত্ব। এই দূরত্ব তৈরি করেছে পথের পরিচালকরা।
এখন পথ উল্টো জানতে চাইতে পারে, তার পরিচালক আদৌ কেউ আছে কিনা নির্দিষ্ট করে? কিংবা তার পরিচালক দাবিদারদের কার কতোটুকু দাবি পথের কাছে। সিটি করপোরেশন বলবে পথ তারা ঝাঁড়ফুক দিয়ে রাখে, বাতি জ্বালিয়ে রাখে, সড়ক দ্বীপ তৈরি করে দেয়, সিগন্যাল বাতি স্থাপন করে এবং কোন কোন পথের পিচঢালা ও মেরামতের কাজ করে দেয়, অতএব পথের ব্যবহার তারা করতে পারে যেমন খুশি ভাবেই।
সুতরাং যখন তখন তারা নিজেরা পথ খুঁড়ে রাখছে। অন্যদের অনুমতি দিয়ে দিচ্ছে পথ খোলা বা আটকে রাখার। ট্রাফিক পুলিশ ভাবছে পথ চলবে তাদের চোখ রাঙানিতে। আম মানুষের কণ্ঠে আওয়াজ থাকবেনা। তারা যেমন গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের রাঙানিতে পুতুল সেজে নড়নচড়ন করেন। গণমানুষও তাই করবে।
বাস্তবতা হলো আম মানুষকে তাই করতে হচ্ছে। ফলে ট্রাফিক সিগন্যাল বা পথের যে কোন প্রান্তে অনন্ত সময়ের জন্য জড় পদার্থ হয়ে যাচ্ছি আমরা। গণপরিবহন ‘বিশেষ’ প্রশ্রয়েই হয়ে উঠছে প্রাণহরণের যন্ত্র। নিরুপায় মানুষ তাই পথ চলার সকল মনস্তত্ত্ব ও সূত্র ভুলে ভারসাম্যহীন হয়ে ছুটছে পথে। দেখুন আমি, আমরা কতো অসহায় তাদের কাছ। যারা আছেন এই শহরে বিশেষ হয়ে।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ