প্রভাষ আমিনঃ জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বাতিলের ঘোষণা শুনেই মনে হয়েছে, তিনি খুব আনন্দের সঙ্গে এ সিদ্ধান্ত নেননি। বরং তিনি একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের জন্য কোটা বহাল রাখার পক্ষেই তার নৈতিক অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন।
কোটা বাতিলের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। আন্দোলন করে দাবি আদায় করেছে বলেই যদি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মনে করে তারা দেশটা কিনে নিয়েছে এবং তাদের যে কোনো দাবিই সরকার মেনে নিতে বাধ্য, তাহলে সেটা ভুল হবে।
‘আন্দোলনের শুরুতে পুলিশ যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করেছে, আন্দোলনের মাঝে ছাত্রলীগ যেভাবে মাস্তানি করেছে; তাতে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর সংগঠকদের নানাভাবে হয়রানি করার শঙ্কার যৌক্তিকতা তৈরি হয়। সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রীদের হয়রানি করার আগেই মাঠে নেমেছে পুলিশ। আন্দোলনের তিন সংগঠককে গোয়েন্দা পুলিশের তুলে নেয়া, এক সংগঠকের বাবাকে থানায় ডেকে নেয়ায় সেই শঙ্কা সত্যি হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরদিন আন্দোলনকারীরা তাদের কর্মসূচি স্থগিত করে। তবে আমার আশঙ্কা ছিল, আন্দোলন স্থগিত হয়ে গেলেই আন্দোলনের সংগঠকদের হয়রানি করা হতে পারে। আসতে পারে হুমকি-ধামকি। আমার এ আশঙ্কার ভিত্তি ছিল, ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে আন্দোলনে অংশ নেয়ার দায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হুমকি দিয়েছে ছাত্রলীগ নেতারা। কোথাও কোথাও মারধোরের ঘটনাও ঘটেছে।
এমন ঘটনা থেকেই সুফিয়া কামাল হলে ঘটে গেছে লঙ্কাকান্ড। তবে ২৪ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেই ছাত্রলীগ প্রমাণ করেছে সুফিয়া কামাল হলের ঘটনা তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এখন সেই অন্তর্দ্বন্দ্বে এক পক্ষের হয়ে লড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল প্রশাসন। রগ কাটার মিথ্যা অভিযোগে ছাত্রীদের উত্তেজিত করে এশার গলায় জুতার মালা দিয়ে তাকে হেনস্থা করা অন্যায় হয়েছে। কিন্তু এক জুতার মালা তো তার অতীতের সব অপকর্মকে বৈধতা দেয় না। সে যেটুকু অন্যায় করেছে, তার বিচার হতে হবে। তার প্রতি যেটুকু অন্যায় হয়েছে, বিচার হতে হবে তারও।
কিন্তু ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুপারসনিক গতিতে এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাকে আবার ‘দানব’ হয়ে ওঠার লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। এখন এশা মাঠে নামার আগেই হল প্রশাসন মাঠ পরিষ্কারের দায়িত্ব নিয়েছে। যারা কোটা আন্দোলনে গেছে, যারা এশার মার খেয়েছে বেছে বেছে তাদেরকেই এখন হয়রানি করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো তদন্ত ছাড়া, কারণ দর্শাও ছাড়া হল কর্তৃপক্ষ কোন কর্তৃত্ব বলে মধ্যরাতে মেয়েদের হল থেকে বের করে দিচ্ছে?
আন্দোলন করা তো অপরাধ নয়। আর ফেসবুকে কেউ গুজব ছড়ালে সেটা দেখার জন্য পুলিশ আছে। হল কর্তৃপক্ষ কোন অধিকারে মেয়েদের মোবাইল চেক করছে? ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে একটা বিষয় আছে, সে ব্যাপারে মনে হয় কোনো ধারণাই নেই সুফিয়া কামাল হলের যুবলীগ নেত্রী প্রভোস্টের।
আন্দোলনের শুরুতে পুলিশ যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করেছে, আন্দোলনের মাঝে ছাত্রলীগ যেভাবে মাস্তানি করেছে; তাতে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর সংগঠকদের নানাভাবে হয়রানি করার শঙ্কার যৌক্তিকতা তৈরি হয়। সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রীদের হয়রানি করার আগেই মাঠে নেমেছে পুলিশ। আন্দোলনের তিন সংগঠককে গোয়েন্দা পুলিশের তুলে নেয়া, এক সংগঠকের বাবাকে থানায় ডেকে নেয়ায় সেই শঙ্কা সত্যি হয়েছে।
আগে থেকেই আমরা দাবি জানিয়ে আসছিলাম, শুধু আন্দোলন করার কারণে যেন কাউকে হয়রানি করা না হয়। কারণ দাবি যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক, আন্দোলন করা কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা যখন মামলা প্রত্যাহারের আলটিমেটাম দেন তখন আমরা বুঝি, দেশটাকে তারা মামাবাড়ি মনে করেন। মামলা প্রত্যাহারের দাবিকে দাবি মনে হয় না, মনে হয় আবদার। এ আন্দোলনের দাবি পূরণের সাথে ন্যূনতম সম্পর্ক না থাকার পরও যেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায় তান্ডব চালানো হয়েছে তার কোনো নজির নেই। এর আগে কখনোই, এমনকি একাত্তর সালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবনে হামলা হয়নি। আর এবার যেভাবে উপাচার্যের বাসভবনকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়েছে, তা রীতিমত আতঙ্কের। তো উপাচার্যের বাসায় হামলাকারীদের বিচার করা যাবে না? মামলা প্রত্যাহার করা হলে বিচারটা হবে কিভাবে?
আমরা দাবি করছি, উপাচার্যের বাসভবনে হামলার সাথে জড়িত প্রত্যেকটি ব্যক্তিতে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আর হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে পুলিশের অনেকের সাথেই কথা বলতে হবে। কিন্তু পুলিশের উচিত, যথাযথ নিয়ম মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে আলাদা কথা। তবে যেভাবে তিন সংগঠককে রাস্তা থেকে জোর করে তুলে নেয়া হয়েছে, তা আতঙ্ক ও উত্তেজনা ছড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ভিসির বাসায় যারা তান্ডব চালিয়েছে, তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু সেই মামলায় যেন কাউকে হয়রানি করা না হয়।
আইনের মূল কথাই হলো, ১০ জন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, কিন্তু একজন নিরপরাধও যেন সাজা না পায়। এ ক্ষেত্রে তা নিশ্চিত করতে হবে। হল থেকে মেয়েদের বের করে দেয়া, পুলিশের ডেকে নেয়ার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, তারা আসলে ভয় দেখাতে চাইছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার দায় পুরোটাই পুলিশের। শুরুতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ওপর হামলা চালিয়েই আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রের বাইরে নিয়ে যায় পুলিশই।
প্রধানমন্ত্রী দাবি মেনে নিয়ে যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। তখন পুলিশ এভাবে রাস্তা থেকে জোর করে আন্দোলনকারীদের তুলে নিয়ে, আন্দোলনকারীর বাবাকে থানায় নিয়ে পরিস্থিতি আবার ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে। এই আন্দোলন তো বটেই, যুগ যুগ থেকেই এটা সত্যি জোর করে দাবি দমিয়ে রাখা যায় না। আর ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না।
রাস্তা থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়াটা অবশ্যই অন্যায়। কিন্তু তুলে নেয়ার ঘণ্টাখানেক পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। ফিরে এসে তারা দাবি করেন, তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভও করেন, সৃষ্টি হয় নতুন উত্তেজনা। কিন্তু পরে পুলিশ দাবি করেছে, ভিসির বাসায় হামলাকারীদের ব্যাপারে তথ্য জানতে তাদের গোয়েন্দা কার্যালয়ে আনা হয়েছিল বটে, তবে চোখ বাঁধা হয়নি।
আর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের ছেড়েও দেয়া হয়েছে। পরে সেই তিনজনের একজন রাতে এক টিভি টক শোতে স্বীকার করেছেন, তাদের চোখ বাঁধা হয়নি। তাহলে কেন তারা এ মিথ্যাচার করলেন? কারণ চোখ বাঁধার বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে ক্যাম্পসে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে পুলিশ বিনা নোটিশে রাস্তার মাঝখান থেকে তুলে চোখ বেঁধে নিয়ে যাবে, এটা হতেই পারে না। এমনিতেই পুরো বিষয়টি স্পর্শকাতর। চোখ বাঁধার দাবি করে, তাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করা হয়েছে। এখন তো দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই মেধাবীরা বরাবরই আন্দোলনে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে নানা গুজবের আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রথম রাতেই এক ছাত্রের মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হয়। পরে ছড়ানো হয় এক ছাত্রীর রগ কাটার গুজব। এরপর আসলো চোখ বাঁধার গুজব। এভাবে গুজবের ওপর ভর করেও আন্দোলনে নৈতিক জয় মেলে না। মূল দাবির যৌক্তিকতা দিয়েই আপনাকে লড়াই করতে হবে।
আন্দোলনকারীরা বারবারই বলছে, তারা বাতিল চায়নি, কোটা পদ্ধতির সংস্কার চেয়েছে। শুনতে খুবই ভালো শোনায়। কিন্তু ৫৬ শতাংশ কোটাকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার আবদার আসলে সংস্কার নয়, বাতিলেরই নামান্তর। ১০ শতাংশে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরি, আদিবাসী, নারী, জেলা এবং প্রতিবন্ধী কোটার সমন্বয় করা হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তারা আসলে বাতিলই চেয়েছে। চক্ষুলজ্জার কারণে সংস্কারের দাবি করেছে। তবে আমার মনে হয়েছে আন্দোলনের মূল টার্গেট ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা।
২০১৩ সাল থেকেই আমি আমার এই সন্দেহের কথা বলে আসছি, মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করতে চায়, এমন একটি মহল পেছন থেকে এই আন্দোলনের কলকাঠি নাড়ছে। তবে আন্দোলনকে ঢালাওভাবে জামায়াত-শিবির-রাজাকার বলে চিহ্নিত করার চেষ্টাটাও ঠিক নয়। পেছনের মহলটি যেই হোক, এই আন্দোলনে অংশহগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী।
বাম সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তো আছেনই, এবারের আন্দোলনে আছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও। আন্দোলনের সংগঠকদের একজন রাশেদ খানের শিবির সংশ্লিষ্ঠতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু এই একজনকে দিয়ে পুরো আন্দোলনকে হেয় করার কোনো মানে হয় না। প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণার পর আন্দোলন স্থগিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতিশীলতা আসেনি। থেমে যাওয়া আন্দোলনের আগুন যারা খুচিয়ে খুচিয়ে আবার জ্বালাতে চাইছেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে চাইছেন; তারা অবশ্যই সরকারের বন্ধু নয়।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ