সত্তরের দশকের শুরুতে এদেশে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ ছিল দরিদ্র, বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পরিচিতি হয়েছিল তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে। সেই বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার নামিয়ে এনেছে শতকরা ২০ ভাগে। ১৯৯২ সালেও যেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ২২০ মার্কিন ডলার আজ তা উন্নীত হয়েছে ২০৬৪ ডলারে।
সত্তরের দশকের গড়ে তিনভাগ জিডিপির প্রবৃদ্ধি বর্তমান দশকে প্রায় সাত শতাংশ করা হয়েছে। উন্নয়নের সুফল অবশ্য দরিদ্র মানুষের কাছে যতটা পৌঁছেছে তার চেয়ে বেশি পৌঁছেছে ধনীদের কাছে। একদিকে এদেশে ধনীদের সংখ্যা এবং তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। অন্যদিকে দারিদ্র্যের হার কমলেও অনেকেই দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছেন। তার মানে তাদের অবস্থা দরিদ্র না হলেও খুব বেশি শক্তভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। আর তাই ধনী-দরিদ্রের সম্পদের ব্যবধান বেড়েছে।
আবার যেখানে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড়আয়ু ছিল ৪৬ বছর, তা ২০১৭ সালে তা হয়েছে ৭২.৮ বছর। উন্নয়নের এই সাতকাহনের নানান চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে আমরা অনুভব করেছি, বাংলাদেশের সম্ভাবনা অপার। আর কৃষি-শিল্প সেবাখাত এই তিন দিকের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে দরকার বড় বড় অবকাঠামো।
একসময় আমাদের ধারণাই ছিল এমন যে বড় অবকাঠামো মানেই বিদেশি অর্থ ও কারিগরি সহায়তা। তাছাড়া এমন অবকাঠামো সম্ভব নয়। যদিও এদেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন ঘটেছে অনেক, তারপরও আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এদেশের প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ান তারাও পারে বড় বড় কাজ করতে। পদ্মা সেতু সে ভুল ভেঙে দিয়েছে আমাদের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিশ্বব্যাংকের কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট হয়ে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, ‘আমরা নিজেরাই বানাবো পদ্মা ব্রিজ’, তখন অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি এটা সত্যিকার অর্থেই সম্ভব। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছি আমরা। হয়তো আর বছরখানেকের মধ্যে আমরা ব্যবহার করতে পারব ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু, যেখানে সড়ক ও রেল উভয় মাধ্যমে সংযোগের সুযোগ থাকছে।
পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব নানামুখী, এই সেতু চালু হওয়ার সাথে সাথেই মানুষ ও পণ্য পরিবহনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূত্রপাত হবে। সেই পথ ধরে বিস্তৃত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য, আর এভাবেই দীর্ঘমেয়াদে দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়বে। পদ্মা সেতু কেবল দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলার সাথে ঢাকার সংযোগকারী একটি সেতুই নয়, এটি উন্নয়নের সুষম বণ্টনের এক আশা জাগানিয়া পথ।
দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর উন্নয়ন, বিশেষ করে শিল্পায়ন অনেক পেছনে পড়ে আছে। এই অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যে কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয় তার সঠিক মূল্য কৃষক পায় না। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বড় শহরের সাথে সংযোগ স্থাপিত হয় নানান রকম কৃষি ও শিল্পপণ্যের বাজার বিস্তৃত হবে। সেটা কেবল ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং নানারকম কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকায় এসে অন্যান্য জেলাতেও সহজেই পৌঁছে যেতে পারবে। তাছাড়া বাজারব্যবস্থার এরূপ সম্প্রসারণ দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প-কলকারখানা গড়ে তুলতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার করবে। তবে তা ত্বরান্বিত হবে যদি ওই এলাকায় পরিকল্পিতভাবে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা যায়।
তাছাড়া পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেল। সুন্দরবন, কুয়াকাটা, ষাট গম্বুজসহ দক্ষিণাঞ্চলের নানান দর্শনীয় স্থানের পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে অবশ্য আরও কিছু অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। পদ্মা সেতুর ব্যবহার শুরু হলে তার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কতটা বাড়বে, তা নির্ভর করবে আরও কিছু সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণের ওপর। যেমন সংযোগ সড়ক, দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য নদীর ওপর সেতু, অর্থনৈতিক জোন গঠন এবং সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়নের ব্যবস্থা।
পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের খরচ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, দুর্নীতির কথা উঠেছে। খরচ বেশি হয়েছে পৃথিবীর অনেক সেতুর তুলনায় সেটা হয়তো ঠিক। কিংবা দুর্নীতির সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে এটা ঠিক যে এত বড় একটি সেতু তার মানের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়নি। আর নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ কেবল নির্মাণসামগ্রীর নয় বরং সময় বেশি লাগায় এটি নির্মাণে যারা নিয়োজিত ছিলেন তাদের বেতন দিতে গিয়েও খরচ বেড়েছে।
আর নির্মাণের সময় প্রলম্বিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নকশায় বিভিন্ন রকমের ভুল সংশোধন করতে হয়েছে। তবে এ কথার মানে এই নয় যে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে বরং পদ্মা সেতুর নির্মাণকে আমরা আমাদের আগামীর জন্য এক বড় অভিজ্ঞতা বলে মনে করতে পারি। আর তাই এই সেতুর নির্মাণব্যয় ও সময় যে সকল কারণে বেড়ে গেছে, কিংবা এই সেতু নির্মাণে আর যেসব দুর্বলতা আছে- সেগুলো যেন আগামীতে না হয় সেই শিক্ষাটাই বড় করে দেখা উচিত।
সবমিলিয়ে বিষয়টাকে এভাবে দেখতে চাই যে পদ্মা সেতু আমাদের নিজেদের টাকায় এক বিশাল উদ্যোগ, যার নির্মাণেও বিদেশি প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ান শ্রমিকদের সঙ্গে বাংলাদেশিরাও ছিলেন। এর ফলে এদেশের প্রকৌশলী, শ্রমিক, টেকনিশিয়ান ও অন্যান্যদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে যে তারা নিজেরাই পরবর্তীতে এ ধরনের বড় কাজ করতে পারবেন বিদেশি বিশেষজ্ঞ ছাড়াই।
পদ্মা সেতু একটি সম্ভাবনার যাত্রা শুরুর চাবি। সেই চাবি দিয়ে কতগুলো সম্ভাবনার দ্বার খুলব, আমাদের তা এখন ভাবতে হবে। এই সেতুকে ঘিরে তৈরি হতে হবে মাস্টারপ্ল্যান, যেখানে শিল্প-কলকারখানা, পর্যটনকেন্দ্র, উন্নত বন্দর, বিজয়ের আনন্দকে উদযাপন করতে গিয়ে আগামীর নতুন অর্থনৈতিক বিজয়কে আসুন স্বাগত জানাই।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ।