সবার আগে.সর্বশেষ  
ঢাকামঙ্গলবার , ৩ ডিসেম্বর ২০১৯
আজকের সর্বশেষ সবখবর

নস্টালজিয়াঃ মায়ার বাধন-৭

অনলাইন ভার্সন
ডিসেম্বর ৩, ২০১৯ ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

মোঃ মোস্তফা হারুন বরেন্দী: বেলকুচিতে বদলী হওয়ার কারণে বাবা আমাদের সকলকে পাঠিয়ে দিলেন নানার বাড়ীতে। সেবার আমরা রাজশাহী থেকে ট্রেনে করে বগুড়ায় ফিরে এলাম এবং বাবা সরাসরি জয়েন করার জন্য চলে গেলেন বেলকুচিতে। যেদিন ট্রেনে রাজশাহী থেকে বগুড়া স্টেশনে পৌছিলাম।আমাদের নেয়ার জন্য মজুমামা টমটম গাড়ী নিয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। তখন দেশে যান্ত্রিক গাড়ী অতি অল্প।যোগাযোগের অন্যতম মাদ্ধ্যম ছিলো।

ঘোড়ার গাড়ী,গরুর গাড়ী।এখনকার মত সি এন জি,টেম্পু,হিউম্যান হলার,বাস ছিলো না।বাস ছিলো দূরপাল্লার। যাহোক, মহানন্দে সবাই মালপত্র সহ ঘোড়ারগাড়ীতে চেপে বসলাম। চলতে শুরু করলো টমটম গাড়ী। টগবগ আওয়াজ করে চলছে সাতমাথা হতে মাঝিড়ার দিকে।তখন রাস্তার পাশ দিয়ে অত অট্রলিকা ছিল না,না ছিলো রাস্তার দুপাশে শোরুমের বা দোকানপাট। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে ছিলো তৈলের জ্বালানির ল্যাম্পপোস্ট। ঘোড়ার গাড়ী বা গরুর গাড়ীতে ছিলো হারিকেন,রাতের বেলায় চলার জন্য।

টমটম গাড়ী মাঝিড়ায় পৌছার আগেই সন্ধ্যা হয়ে এলে ঘোড়ার গাড়ীর চালক রাস্তা পাশে গাড়ী সাইড করে, হারিকেন জালালেন এবং গাড়ীর নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিলেন,যেনো রাস্তা আলোকিত হয় এবং গাড়ী চলতে সুবিধা হয়। সন্ধ্যার পড় করতোয়া নদী পারাপারের জন্য ছিলো দুই, তিনটি নৌকা জোড়া দিয়ে বাশ বিছিয়ে বিশেষ ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো। যাতে অনায়াসে ফেরির মতো তিন চারটি ঘোড়া অথবা গরুর গাড়ী পারাপার করা যেতো। সেই বিশেষ ফেরিতে আমরা টমটম সহ পার হলাম।গ্রামের পথ শুরু হলো।

কাচা উচুনিচু রাস্তা।অন্ধকার পথ।হ্যারিকেনের আলোতে আমাদের টমটম চৌপিনগর গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। উচুনিচু কাচা রাস্তায় দোল খেতে বেশ মজা পাচ্ছিলাম।বড়দের তো রীতিমতো পেটের ব্যাথা ধরে যেতো। একসময় নানির বাড়ীতে পৌঁছে গেলাম।নানি, মামিরা হ্যারিকেন নিয়ে আমাদের রিসিভ করার জন্য অনেক্ষন ধরে অপেক্ষা করছিলেন বোঝা গেলো। পৌছা মাত্রই মামারা আমাদেরকে কোলে কোলে নামিয়ে বাসার ভিতর নিয়ে গেলেন। কেউ ব্যাস্ত মালামাল নামাতে।

আমাদের আসার খবর পেয়ে হাট থেকে মাংস এনে রান্না করে রেখেছিলেন নানি। আমার মা সাত ভাইয়ের এক বোন।সেই একবোনের সন্তান আমরা।তাই,মামা মামি সবাই আমাদের আদর করতেন।নানা বেচে নেই। আমার জন্মের পর নানা ১৯৬৫ সালে হজ্ব করতে যান।তখনকার দিনে হজ্বে যেতে হতো সাগর পাড়ী দিয়ে বড় বড় জাহাজে করে। একমাস,দেড়মাস লাগতো মক্কায় পৌছিতে। হজ্বে গিয়ে নানা আর ফিরে আসেননি। সেখানেই মারা যান।তার সংগী সাথীগন ফিরে আসলে।

নানার মৃত্যুর খবর সবাই পেয়েছিলেন। অন্ধকার রাতে গ্রামের বাড়িতে রাত ৮টার ভিতর সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো।আমরাও রাতের খাবার খেয়ে নিলে মা সবাইকে ঘুমিয়ে দিলেন চৌকির উপর। একদিন আমি ও আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই সাজু এবং মামাতো ভাই বাদশা শহরে দাদার বাসায় বেড়াতে গেলাম।দাদার বাড়ীতে ছোট চাচা এবং তার পরিবার থাকতেন। বড় জ্যাঠা থাকতেন একই মহল্লার ৫০০ গজ দূরে পৌত্রিক ভিটায়।দাদাকে দেখিনি।বাবার বয়স যখন ৫/৬ বছর ছিলো, তখন দাদা ইন্তেকাল করেন।বাবার মুখে গল্প শুনেছি, দাদা খুব অল্প বয়েসে কালা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।মারা যাওয়ার ২/৩ দিন আগে বলতেন,আমি বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টার ট্রেনে চলে যাবো। তিনি ঠিকই বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় ইন্তেকাল করেছিলেন।

দাদার বাড়ী,জ্যাঠার বাড়িতে ঘুড়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। দাদী তো রাতে থাকার জন্য জোড় করতে লাগলেন। আমরা দাদীর কথা না শুনে সন্ধ্যার সময় বাড়ী থেকে বের হয়ে গেলাম।আমাদের মুল গোপন উদ্দেশ্য ছিলো সিনামা দেখা। বাড়ী থেকে বের হয়ে শহরের উত্তরা সিনামা হলে সন্ধ্যা ৬ টার শোতে বাংলা ছবি দেখলাম।ছবিটার মনে নেই।রাত ৯ টায় ছবি শেষ। পেটে ক্ষুধা চেপে বসলো। উপায় নেই, টাকাও বেশি নেই যে কিনে খাবার খাবো। একবার ভাবলাম দাদীর বাড়ীতে ফিরে যাই।

আরেকবার ভাবি দাদীর ওখানে ফিরে গেলে কৈফিয়তের মুখোমুখি হতে হবে।এতো রাতে কোথা থেকে আসলাম। তাই ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত বাদ দিলাম।ওদিকে মা ভাবছে আমরা হয়তো দাদীর বাড়ীতে থেকে গেছি। উপায়ন্তর না দেখে চরম সিদ্ধান্ত নিলাম যে করেই হোক মার কাছেই ফিরে যাবো। আমরা সাতমাথাতে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। রাত ৯ টা মানে সেসময়কার অনেক রাত।কোন গাড়ীই পাচ্ছিলাম না।গরুর গাড়ী,ঘোড়ার গাড়ী,বাস,রিক্সা কিছুই পেলাম না।

আকস্মিক খেয়াল করলাম একটি ট্রাক মাঝিড়ার দিকে যাচ্ছে অর্থাৎ ঢাকাগামী মালবাহী ট্রাক।সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এটার পিছনে ঝুলে ঝুলে চলে যাবো। শহর থেকে মাঝিড়ার দুরত্ব ৬ মাইলের মত হবে।ট্রাক ছাড়ার সাথে সাথেই আমরা তিনজন ট্রাকের পিছনের রড ধরে ঝুলে পড়লাম।কিছুক্ষণ অর্থাৎ ১০/১৫ মিনিটের ঝুলন্ত অবস্থার অবসান ঘটিয়ে আমরা পৌছে গেলাম মাঝিড়াতে ট্রাকের ড্রাইভার টেরই পেলোনা পিছনে তিনজন ঝুলন্ত মানব কিশোর ছিলো। এবার আরও শক্ত অভিযান।করতোয়া নদী পার হতে হবে তারপর গেয়ো মেঠো পথ অতিক্রম করে মায়ের কাছে পৌঁছাতে হবে। (চলবে)

মোঃ মোস্তফা হারুন বরেন্দী, সিনিঃ সহকারী পুলিশ সুপার

“কাহিনীটি মোঃ মোস্তফা হারুনের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া”.

এমকে

বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।