ঢাকাবৃহস্পতিবার , ১২ ডিসেম্বর ২০১৯
আজকের সর্বশেষ সবখবর

নস্টালজিয়াঃ মায়ার বাধন -১৬

অনলাইন ভার্সন
ডিসেম্বর ১২, ২০১৯ ৮:১০ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

মোঃ মোস্তফা হারুন বরেন্দী: ১৯৯৮ সালের একটি ঘটনা যা আজও স্মৃতিপটে ভেসে বেড়ায়।১৯৮৮ সালের বাবার চাকুরির পরিসমাপ্তি ঘটে। তারপর থেকে আমার বাসাতেই অধিকাংশ সময় থাকতেন।আবার যখন মন চাইতো কিছুদিনের জন্য বগুড়ায় চলে যেতেন।আমি তখন মিরপুর -১৪ নং পুলিশ কোয়ার্টারের ৮ নং ব্লিডিং এর ৫ম তলায় থাকতাম স্বপরিবারে। ২৫ নভেম্বর আমার বড় মেয়ে মনোলোভা মোস্তফা গোধুলির জন্মদিন পালনের জন্য বাসায় আয়োজন করেছি।আমার মেয়ে

তখন কেজি তে এডভান্টিস ইন্টারন্যাশনাল ( ইংলিশ মিডিয়াম) স্কুলে লিখাপড়া করে।সন্ধ্যার পর কেক কাটার আয়োজন হয়।প্রতিবেশী পুলিশ অফিসার পরিবার আমন্ত্রিত ছিল। যথারীতি রাত ৯.৩০ ঘটিকার ভিতর জন্মদিনের সকল আয়োজন শেষ হয়।রাত ১০ টায় অথিতিগন চলে যাবার পর আমি,আমার ছোট ভাই সাজু ও বাবা খাবার টেবিলে খাবার গ্রহন করছিলাম। আমার স্ত্রী আমাদের খাবার পরিবেশন করছিল।খাবার গ্রহনের এক ফাকে বাবার প্রাকৃতিক ডাক আসলে তিনি খাবার রেখে দ্রুত টয়লেটে চলে যান। ২/১ মিনিটের ভিতর টয়লেট থেকে

বের হয়ে এসে আমাকে বললেন,আমার অক্সিজেনের দরকার, খুব শ্বাস কস্ট হচ্ছে।তিনি দ্রুত অস্থির হয়ে পড়ছিলেন এবং দ্রুত স্বাস নেয়ার চেস্টা করতে করতে বিছানায় বসে পড়লেন ও বললেন তোমরা দ্রুত ব্যাবস্থা নাও,আমি ভিষন খারাপ অনুভব করছি। তখন কাল বিলম্ব না করে আমি ও সাজু খাবার অসমাপ্ত রেখেই হাত ধুয়ে কোন রকমে গায়ে জামা পড়ে লুংগি পড়েই দুই ভাই বাবার দুই হাত দুজনার কাধে নিয়ে পাচ তলা থেকে নেমে পড়লাম। উদ্দেশ্যে আপতত ১৪নং মোড়ে সেনাবাহিনীদের দ্বারা পরিচালিত মারকস মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে নেয়া।রাত বেশি হওয়ায় ক্যাম্পাসে কোন রিক্সা পেলাম না।দুই ভাই বাবাকে

কাধে করে নিয়েই হাসপাতালে গেলাম।ইমারজেন্সিতে নিলাম।কোন ডাক্তারকে পেলাম না। হাসপাতাল কতৃপক্ষকে আমার পরিচয় দিলাম।এটেন্ডেস বললেন স্যার অপেক্ষা করেন আমি ব্যাবস্থা নিচ্ছি।কিছুক্ষণের ভিতরেই ডাঃ লেঃ কঃ শহীদ সাহেব গাড়ি নিয়ে চলে আসলেন।গাড়ী থেকে নেমেই তিনি ইমারজেন্সিতে আমাকে সহ ঢুকলেন।ততক্ষনে বাবা নিশ্চুপ হয়ে গেছেন।ধীর গতিতে শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে। মুখ দিয়ে গোলাপি রঙয়ের ফেনাযুক্ত লালা বের হতে লাগলো। ডাক্তার সাহেব জরুরি কিছু ইঞ্জেকশন দিলেন।আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ব্যার্থ হয়ে বললেন,এখানে রাখা বিপদজনক হবে, দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে

নেয়ার পরামর্শ দিলেন।ডাক্তার নিজ দায়িত্বে তাদের হাসপাতালের এম্বুলেন্স ও অক্সিজেনের ব্যাবস্থা করে দিলেন।আর বললেন বাচার আশা ১%। কি আর করা ইতিমধ্যে আমার স্ত্রী চলে এসেছে।রাত তখন ১২ টা বেজে গেছে।আমি হাসপাতালের বয়ের সাহায্য নিয়ে বাবাকে দ্রুত এম্বুলেন্সে তুললাম।আমি,আমার স্ত্রী, সাজু তিন জন মিলে এম্বুলেন্সে উঠে বাবার মাথাটাকে আমার কোলের ভিতর নিলাম।তখনও মুখ দিয়ে রক্তমাখা লালা বের হচ্ছিল।আমি বার বার আমার রুমাল দিয়ে বাবার মুখের রক্ত মুছে দিচ্ছিলাম।জ্ঞান নেই।আমার স্ত্রী, আমার ছোট

কন্যা দুটিকে আমার ছোট বোনের কাছে রেখে চলে এসেছে।রাত বেশি হওয়ায় রাস্তা ক্লিয়ার ছিল।দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পৌছিলাম।এম্বুলেন্স থেকে ট্রলিতে উঠালাম। এটেন্ডেস এসে বাবার অবস্থা অতি খারাপ দেখে তিনি বাবাকে ট্রলিতে তুলে নিয়ে রওনা হওয়ার সময় বললেন আপনি টিকিট কেটে নিয়ে আসুন,আমি রোগীকে নিয়ে আই সি সি ইউ তে যাচ্ছি।আমি সাজুকে টিকিট কাটতে দিয়ে ট্রলির সাথে আই সি সি ইউ তে রওনা করলাম। আই সি সি ইউ তে এমন জরুরি ২২ জন রোগীকে দেখতে পেলাম,সবারই অবস্থা আশংকাজনক। আই সি সি ইউ তে রোগীর কারো ঢোকার নিয়ম না থাকলেও, আমি ঢাকা

মেট্রো পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার পরিচয় দেওয়ায় ডাক্তার সাহেবগন আমাকে এলাও করলেন। দ্রুততার সাথে বাবার চিকিৎসা চলছে।প্রথমে চললো বুকে ইলেট্রিক শকের ব্যাবস্থা, বেশ কিছুক্ষণ চালালেন এই প্রক্রিয়া। কিন্তু মনিটরে বাবার লেখচিত্র বারবার সরল রেখায় রুপ লাভ করছে। ডাক্তার আমাকে বললেন,আমি আশাবাদী হতে পারছিনা।ইতিমধ্যে আই সি সি ইউ এর ২২ জনের ভিতর ১০ জনই মাইনাস হয়ে গেছে অর্থাৎ মারা গেছে। এরপর ডাক্তার বললেন এবার শেষ একটা প্রচেষ্টা নিব। হায়াত থাকলে ফিরে আসবেন,না

থাকলে বিদায়। এই বলেই ডাক্তার সাহেব মোটা সুচের মোটা বড় আকারের একটি সিরিঞ্জ নিয়ে এলেন এবং একটি ইঞ্জেকশন এর পাওডারযুক্ত সিল্ড শিশি নিয়ে এলেন।প্রথমে সিরিঞ্জ দিয়ে বাবার হাত থেকে অনেক রক্ত বের করে নিলেন,তারপর রক্তগুলি সেই পাওডার যুক্ত সিল্ড বোতলে পুস করে রক্ত ঢুকালেন। কিছুক্ষণ রক্ত ও পাওডার ঝাকিয়ে ভালভাবে মিক্সড করলেন।এরপর আবার ঔষধ যুক্ত রক্ত সিরিঞ্জে ভরে নিয়ে ডাক্তার সাহেব তা বাবার তলপেটের নিম্নে পুস করে ঢুকিয়ে দিয়ে ডাক্তার তার দৃস্টি মনিটরে নিবন্ধ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ডাক্তারের মুখে কোন কথা নেই,যেনো তিনি রোগীকে ফিরে আনার যুদ্ধের

চ্যালেঞ্জে নেমেছেন।ইতিমধ্যে ৮/১০ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে।ডাক্তারের মুখে একটু একটু হাসির ছোয়া দেখতে পেলাম।মনিটরে রেখচিত্র উপর নীচে আকাবাকা হয়ে ভেসে উঠতে থাকলো।ডাক্তার আমাকে বললেন,আল্লাহ হয়তো এই যাত্রায় রোগীর জীবন ভিক্ষা দিয়েছেন।দেখা যাক ৭২ ঘন্টা অতিবাহিত হউক। বাইরে কে আছে তাদের দেখে চলে যেতে বলেন।আর একজনকে রোগীর কাছে রাখেন।আমি জানিয়ে দিলাম আমিই রোগীর কাছে থাকবো। আমার স্ত্রী,সাজু ভিতরে এসে বাবাকে দেখলো। আমি সাজুকে বললাম,তুই তোর

ভাবিকে নিয়ে চলে যা।রেস্ট নিস।কাল সকাল ৯ টা অথবা ১০ টার দিকে চলে আসিস।এরপর আমি রেস্ট করে অফিসে চলে যাব।তখন রাত আড়াইটা।ওদের বিদায় দিয়ে আমি একটি চেয়ার নিয়ে বাবার পাশে নিদ্রাহীন রাত কাটাতে থাকলাম।ভোরের আযানের সময় বাবার জ্ঞান ফিরে এলো। আস্তে করে চোখ খুলে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোথায়?আমি সংক্ষেপে সব বললাম।বাবা সব শুনার পর পরম আদরে আমার মাথাটা বুকের ভিতর টেনে নিয়ে বলেছিলেন,তুমি আমার জন্য অনেক কস্ট করে রাত জেগে আমার পাশে বসে সেবা

করছো,আল্লাহ তোমার মংগল করবেন।আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবন দান করুক।আমি যদি মারা যাই,সব ভাই বোনদের দেখে রেখো,তাদের মানুষ করবে,তাদের দূরে সরে দিবেনা।এখন তুমিই তাদের অভিভাবক। জবাবে শান্তনা দিলাম এসব নিয়ে কখনও ভাববেন না।আমি কাউকেই কস্ট দিবনা। যাহোক, ৭২ ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। (চলবে)

মোঃ মোস্তফা হারুন বরেন্দী, সিনিঃ সহকারী পুলিশ সুপার

“কাহিনীটি মোঃ মোস্তফা হারুনের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া”.

বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।