ঢাকারবিবার , ৮ ডিসেম্বর ২০১৯
আজকের সর্বশেষ সবখবর

নস্টালজিয়াঃ মায়ার বাধন-১২

অনলাইন ভার্সন
ডিসেম্বর ৮, ২০১৯ ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

মোঃ মোস্তফা হারুন বরেন্দী: ২০০৬ সালে সেই বেলকুচিতে ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গেলাম,তখন বেলকুচির আমুল পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।আগে হাতে গোনা কিছু ধনী ব্যাক্তির স্থলে অনেক অনেক ধনী ব্যাক্তির জন্ম হয়েছে।তাদের লিখাপড়ার মান অনেক ভাল হয়েছে।নুতন ধনীদের ভিতর ঢাকা ব্যাংকের মালিক আব্দুল হাই সরকার, আলতাফ সরকার,বিশিষ্ট টেক্সটাইল মিলের মালিক সাবেক এম পি আব্দুল মজিদ মন্ডল ও আরও অনেক।

আর যাদেরকে ধনী দেখেছিলাম,তারা এখন দারিদ্রতার চাদরে মোড়ানো। সেই আলমাস কোম্পানির আলমাস কাকা বেচে আছেন,তবে আগের মত অবস্থা নেই। মোটামুটি সাধারণভাবে দিনাতিপাত করছে। ফয়জুল্লাহ খান মারা গেছে।তার ছেলে রেজাউল হিরোইন খোর হয়ে গেছে।ভাবি আল্লাহ কখন কাকে ধনী বানাবেন আবার কখন কাকে দরিদ্র বানাবেন একমাত্র তিনিই জানেন। বাবার পুরাতন ক্লাইন্টগন তখন আমার সাথে দেখা করতে আসতেন। কারন আমি তাদের প্রিয় ব্যাংকার হারুনার রশীদ সাহেবের ছেলে।তারা আমাকে আদর করে ভাতিজা বলেই ডাকতেন।

নিমন্ত্রণ করতে ভুলতেন না।বাবার বন্ধু ছিলেন তাই আমিও তাদেরকে কাকা বলেই ডাকতাম। খোজ নিলাম সাখাওয়াত ডাক্তার সাহেব ও লাইজুর।খোজ নিয়ে জানতে পারলাম লাইজুর বিয়ে হয়ে গেছে।লাইজুর স্বামী মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চাকুরী করে।সংসারে শান্তি নেই।মা হয়েছে।ঢাকা মনিপুর এলাকায় বাসা নিয়ে থাকে। লাইজুর মা পরকিয়া প্রেম করে ডাক্তার সাহেবকে ছেড়ে অন্য জায়গায় ঘড় বেধেছে। ডাক্তার সাহেব একাকি জীবন কাটাচ্ছেন।বৃদ্ধ হয়ে গেছেন।খোজ নিয়ে বাড়ী প্রযন্ত কয়েকদিন গিয়ে দেখা পাইনি।সেই বাড়ী সেরকমই আছে।কোন পরিবর্তন নেই।

বেলকুচিতে অনেক দালান কোঠা হয়েছে,পাকা বাড়ী হয়েছে, রাস্তাঘাট হয়েছে,উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে কিন্তু ডাক্তার সাহেবের কোন পরিবর্তন হয়নি।সেই পুরাতন আমলের টিনসেড বাড়ীতেই থাকেন।ডাক্তার সাহেবের এমন অবস্থা জেনে নিজেকেই অনেক খারাপ লেগেছিলো। যাহোক, বেলকুচিতে ছাগল মারা যাবার ঘটনার পর বাবা মনের কস্ট দূর করার জন্য বাড়ীর ভিতর ফুলের বাগান,পাতাবাহারের বাগান করলেন এবং অফিস থেকে এসে গাছের সেবা করতেন। প্রানীর প্রতি বাবার ভালবাসার আরও একটি উদাহরণ দিচ্ছি।আমি যখন বগুড়া আযিযুল হক কলেজের ছাত্র ছিলাম তখন আমরা বগুড়ার শিববাটী এলাকায় মারফত প্রফেসারের বাসায় বসবাস করতাম।

সেই বাসায় বাবা খড়গোস,কবুতর লালন পালন করতেন,এছাড়াও টিয়াপাখি, তোতাপাখি পালতেন।বাসার আংগিনায় মাটির কোঠরে খোরগোস বাস করতো। সারাদিন বাড়ীময় ঘুরে বেড়াতো লাফিয়ে লাফিয়ে। বাবা অফিস থেকে এসেই ওদের যত্ন করতেন।খাবার খাওয়াতেন। একদিন বাবা অফিসে থাকাবস্থায় তুমুল ঝড়বৃষ্টি হলো। বাসার আংগিনায় পানি জমে গেলো। জমানো পানি খরগোশের ডেরাতেও ঢুকে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। আমি কলেজে ছিলাম,ছোট বোন ভাইয়েরা স্কুলে গিয়েছিলো।

মা একাই বাড়ীতে ছিলেন।একা সবদিকে সামলাতে পারেননি। খরগোশের ডেরায় পানি ঢুকে সব খরগোশ অর্থাৎ ১৫/২০টা খরগোশ বাচ্চাসহ মারা গেলো। বিকালের দিকে বাবাসহ আমরা সবাই বাড়ী ফিরেছি। বাবা এসেই খরগোশগুলির দেখভাল করার জন্য তাদের মাটির ঘড় গুলিতে খোজ নিতে গিয়ে দেখেন একটিও বেচে নেই। বাবার চোখে অশ্রুধারা এবং সেই সাথে প্রচন্ড রেগে গিয়ে মাকে বোকাঝোকা করলেন।

মায়ের কোন দোষ ছিলো না।একাকী প্রচন্ড ঝড়ে মা নিজেই দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলেন।সন্তানের স্কুল কলেজে, কে কেমন আছে তা নিয়েই টেনশনে ছিলেন।বাবা রাগে অভিমানে ২/৩ দিন বাসায় কোন খাবারই খেলেন না।কারো সাথে কথা বলেননি। এই রাগ ও অভিমান ভাংগাতে আমাদেরকে অনেক কস্ট করতে হয়েছিলো। তখন দেখেছিলাম তার পশু প্রেম কত গভীর। বেলকুচিতে থাকাবস্তায় একসময় বাবার বদলীর আদেশ চলে আসে বরিশালে।বদলীর আদেশ পেয়ে বাবার মনটা ভিষণ খারাপ হয়ে যায়।

সেই যুগে বরিশালের সাথে উত্তরবংগের যোগাযোগ ব্যাবস্থা এতই খারাপ ছিলো যে,বরিশাল যেতেই ৩/৪ দিন লেগে যেতো। বাবা উপর মহলে যোগাযোগ করে বদলীর আদেশ বাতিল করতে সক্ষম হন।এবার বাবার বদলী হলো আবার ঢাকায় হেড অফিসে। আবার বাবা আমাদের সকলকে বগুড়ায় আপাতত নানির বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়ে বাবা ঢাকায় হেড অফিসে যোগদান করলেন। বাবা ঠিক করলেন, নানির গ্রামের বাড়ীতে থাকলে আমাদের লিখাপড়ার ক্ষতি হবে,তাই এবার আমাদের বগুড়া শহরে স্থায়ীভাবে রাখবেন স্থির করলেন।

কারণ ঘন ঘন বদলী হওয়ায় আমাদের লিখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। তাই তিনি ছুটি নিয়ে বগুড়ায় এসে নানির বাড়ী থেকে আমাদেরকে শহরে দাদার বাড়ী কাটনার পাড়াতে নিয়ে উঠালেন। দাদা নেই।বাবার শিশুকালে দাদা মারা গিয়েছিলেন।দাদী মানুষ হিসেবে পরহেজগার,রাগী ও সেনসিটিভ ছিলেন।দাদীর মাটির ঘড় ছিলো তিনটি। আমরা দুটি ঘড়ে উঠলাম।আমার বড় বোন দাদীর সাথে একই বিছানায় ঘুমাতেন,সেখানে মামাতো বোন মরজিনা আপাও থাকতেন।

আমিও প্রায়ই মরজিনা আপার সাথে একই খাটে ঘুমাতাম।তিনি বগুড়ায় বানিজ্য কলেজে পড়তেন। আমরা নুতন বাসায় উঠে গেলাম।দক্ষিণ দিকে তিন/চার রুম বিশিষ্ট সেমি পাকা টিনসেড রুমে ছোট চাচা আব্দুর রশীদ বাচ্চু থাকতেন।তিনি বগুড়া রেজিস্ট্রি অফিসে চাকুরী করতেন।তিনিও আজ বেচে নেই।খুব স্বল্পভাষী স্থির প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।কখনো কোন বিবাদে জড়াতেন না।প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন।অত্যান্ত দুঃখের বিষয় তিনিও আজ বেচে নেই (আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুক)।

একদিনের ঘটনা আজও মনে পড়ে, আমি যখন পাবনা ওসি ডিবি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম তখনকার ঘটনা মনে পড়ে, আব্দুর রশীদ বাচ্চু চাচা তার ছেলে মিলনের বাড়ীতে বেড়াতে যান।মিলন পাবনা স্কয়ার ঔষধ কোম্পানির হিসাব বিভাগের বড় অফিসার। একদিন রাতে অফিসে কাজ শেষে ঘুমাতে যাচ্ছিলাম তখন রাত অনুমান ১১ টা হবে। চাচাতো ভাই মিলন আমাকে মোবাইল করে জানায় চাচা ভিষণ অসুস্থ, তাকে পাবনা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।সংবাদ পেয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে গেলাম এবং আমি ও চাচাতো ভাই মিলন মিলে চাচার সেবা শ্রুশুতা করলাম,আমার পাবলিক বন্ধুরাও ছুটে এসে আমাদের সহযোগিতা করলেন।রাত ২/৩ টার দিকে চাচা সুস্থতা বোধ করায় চাচাতো ভাই মিলনকে হাসপাতালে রেখে অনুমতি নিয়ে চলে এলাম।সম্ভবত এটাই ছিলো চাচার সাথে আমার শেষ দেখা।আমার বাবার মৃত্যুর তিন বছর পর ছোট চাচা মারা যান। বাড়ীর পশ্চিম দিকে নিঃসন্তান বড় ফুফু ও ফুফা থাকতেন।তাদের সাথে থাকতেন। (চলবে)

মোঃ মোস্তফা হারুন বরেন্দী, সিনিঃ সহকারী পুলিশ সুপার

“কাহিনীটি মোঃ মোস্তফা হারুনের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া”.

বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।