সবার আগে.সর্বশেষ  
ঢাকাসোমবার , ২১ আগস্ট ২০২৩
আজকের সর্বশেষ সবখবর

কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে বিনিয়োগ করে হলেন গরিব

খবর২৪ঘন্টা ডেস্ক
আগস্ট ২১, ২০২৩ ৫:০১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

পরিশ্রম ছাড়া ঘরে বসে বিনিয়োগ করে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে গ্রাহকের প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (এমটিএফই) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। অনলাইন ট্রেডিং এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের গ্রাহকদের লাভের গুড় তো দেয়নি বরং আরও ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।

গত ৭ আগস্ট সিস্টেম আপগ্রেডের কথা বলে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন সেবা বন্ধ করে এমটিএফই। ফলে অনেকেই অপেক্ষায় ছিলেন যে সিস্টেম আপগ্রেড হওয়ার পর টাকা তুলবেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) রাতে হুট করে প্রায় সব গ্রাহকের ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক দেখানো শুরু করে অ্যাপটি। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তাদের ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। এজন্য উল্টো গ্রাহকদের কাছ থেকেই তারা টাকা পাবে।

জানা গেছে, কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এমটিএফই বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ২০২১ সালে। তিন বছরে এমটিএফইতে শুধু বাংলাদেশ থেকেই ৪২ লাখ মানুষ যুক্ত হয়েছেন। প্রাথমিক অবস্থায় এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত প্রত্যেকেই ৬১, ২০১, ৫০১, ৯০১ ও ২ হাজার ডলার ডিপোজিট করেন। বেশি টাকা আয় করতে কেউ কেউ ৫ হাজার ডলারের বেশিও বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে কেউ জমানো টাকা, কেউবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আবার কেউ জমি বন্ধক রেখে বিনিয়োগ করেছিলেন। বর্তমানে তারা সবাই নিঃস্ব।

এমটিএফইর বেশ কয়েকজন গ্রাহক জানান, অ্যাপটিতে কেউ ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন তাকে প্রায় ১৩ ডলার লাভ দেওয়া হতো। তবে এত অল্প বিনিয়োগে তো বড় লাভ আসবে না। সেজন্য অনেকে ৫ হাজার, ১০ হাজার, এমনকি ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন। বিনিয়োগ যত বেশি, লাভও তত বেশি ছিল। এমনকি প্রতিমাসে বিনিয়োগের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ পেতেন গ্রাহকরা। এমটিএফইতে শুধু বিনিয়োগের ওপর লাভই নয়, কাউকে বিনিয়োগ করাতে পারলে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পাওয়া যেত। এমন করে কারও মাধ্যমে ১০০ জন গ্রাহক বিনিয়োগ করলে তার পদবি হতো ‘সিইওথ। কমিশন আর নিজের বিনিয়োগের অর্থ মিলে ওই কথিত সিইও মাসে ১৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারত।

কোম্পানিটি গ্রাহকদের বলতো, ডলারগুলো দিয়ে তারা ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসা করছে এবং সেখান থেকেই গ্রাহকদের লভ্যাংশ দিচ্ছে। গ্রাহকরা সেটাই বিশ্বাস করে বিনাপরিশ্রমে লাভের আশায় বিনিয়োগ করতো। কিন্তু তারা কখনও ভাবেননি যে প্রতিষ্ঠানটি এভাবে সবার টাকা মেরে দিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে। এখন উল্টো তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে কোম্পানি আরও অর্থ পাবে বলে মাইনাস চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। লাভের আশায় এসে উল্টো ঋণের বোঝাও ধরিয়ে দিয়েছে তারা। এতে করে যারা দ্রুত আয় করার স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা এখন সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেছেন।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক ভুক্তভোগী বলেন, লাভের আশায় ধার করে ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। কিছুদিন তারা ওই টাকার উপর লাভও দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে অ্যাপটি থেকে টাকা উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। এখন শুনছি তারা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এখন কীভাবে ধারের টাকা পরিশোধ করব।

নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের ভুক্তভোগী আলামিন বলেন, একজন বলেছিলেন এমটিএফইতে বিনিয়োগ করলে দিগুণ আয় করা যাবে। পরে একটি এনজিও থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করি। এখন ওই অ্যাপে আর প্রবেশ করা যাচ্ছে না। এখন এনজিওর টাকা কীভাবে পরিশোধ করব কিছুই বুঝতে পারছি না।

এমটিএফইর ফাঁদে পড়ে শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও প্রতারিত হয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রতারিতদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ এবং বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী এবং সাংবাদিকসহ অন্যান্য পেশার মানুষও রয়েছেন।

এদিকে এমটিএফইথর কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারছে না প্রশাসন। কেননা পুরো প্রতারণাই হয়েছে অনলাইনে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অফিস বা প্রতিনিধিও নেই যে তাদের আইনের আওতায় আনবে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ) রেজাউল মাসুদ বলেন, আমরা এর আগেও এ ধরনের অ্যাপের বিরুদ্ধে অনেকবার অভিযান পরিচালনা করেছি। এমটিএফইথর বিষয়ে নজরদারি চলছে। বাংলাদেশে এর যারা পরিবেশক বা প্রচারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের আমরা আইনের আওতায় আনব। এ ছাড়া কেউ যদি অভিযোগ দেন, সে বিষয়েও আমরা ব্যবস্থা নেব। এমটিএফই একটি ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম চক্র। তাদের কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ বায়বীয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, এগুলো অবৈধ লেনদেন। বার বার সতর্ক করার পরও কেন মানুষ এসব জায়গায় বিনিয়োগ করে? বাংলাদেশ ব্যাংকের এখানে সরাসরি কিছু করার নেই। তবে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ইতোমধ্যে এমন ৫০টিরও অধিক সাইট বন্ধ করেছে এবং প্রতিনিয়ত করছে। তবে সাধারণ মানুষের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

এদিকে বিশেষজ্ঞরাও বলছেন সাধারণ মানুষকে সচেতন হওয়ার কথা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, অ্যাপের মাধ্যমে এমন প্রতারণা হলে পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। আগে কারও হাতে হাতে প্রতারণা হতো, কোনো বিপদ হলে তাকে ধরা যেত। এখন ধরবেন কাকে? এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব ব্যাংককে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কোনো সন্দেহজনক লেনদেন হলে তা খতিয়ে দেখতে হবে। তবে এসব বন্ধে জনগণের সচেতনতার বিকল্প নেই। প্রতারকরা আমাদের দেশের কিছু লোকের অতিলোভ কাজে লাগিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, তাই আগে সাধারণ মানুষকেই সচেতন হতে হবে।

বিএ/

বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।