রিয়াজুল হকঃ এখন অনেকেই বলে থাকেন, পরিবারের একজন সন্তান ইয়াবাসেবী থাকলে, সেই পরিবারের ধ্বংসের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। পরিচিত একজন স্কুল শিক্ষক বলছিলেন, সন্তান ইয়াবাসেবী হওয়ার থেকে সন্ত্রাসী হওয়া ভালো। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বললেন, দুই শ্রেণির মানুষই সমাজে ঘৃণিত কিন্তু সন্ত্রাসী কিংবা তার পরিবারের সামনে কেউ উঁচু গলায় কথায় বলে না, সবাই ভয় পায়।
আর ইয়াবাসেবীকে তো রাস্তার লোকজন ধরেও মারধর করে। এরা নিজের ঘরের টাকা চুরি করে, জিনিসপত্র বিক্রি করে ইয়াবার জন্য। পরিবারের মানুষগুলোও থাকে অশান্তিতে। তারপরেও অনেক পরিবার তাদের মাদকসেবী সন্তানের কথা সকলের কাছে গোপন রাখার চেষ্টা করে থাকে, যত সময় না সংসারটি সর্বোচ্চ ধ্বংসের মুখে না পড়ে।
‘বর্তমানে দেশে ইয়াবার ছড়াছড়ি। এই মরণ নেশা দেশের তরুণ সমাজকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে চলেছে। ফলে পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে যে, ইয়াবার মরণ নেশায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম। এখনই যদি কার্যকরভাবে ইয়াবার প্রসার বন্ধ করা না যায়, তবে দেশের ভবিষ্যত তথা তরুণ প্রজন্ম অন্ধকারের পথেই এগিয়ে যাবে।’
বয়লিং ফ্রগ সিনড্রোম মেটাফোরের কথা সকলেরই জানা আছে। একটা ব্যাঙ কে যদি আপনি একটি পানি ভর্তি পাত্রে রাখেন এবং পাত্রটিকে উত্তপ্ত করতে থাকেন তবে ব্যাঙটি পানির তাপমাত্রার সাথে সাথে নিজের শরীরের তাপমাত্রা ভারসাম্যে রাখতে থাকে। লাফ দিয়ে বেরোনোর পরিবর্তে সে পানির উত্তাপ সহ্য করতে থাকে। কিন্তু একসময় পানির প্রচন্ড তাপমাত্রা ব্যাঙের শরীর আর মানিয়ে নিতে পারে না।
যখন সে আর পানির প্রচন্ড তাপমাত্রা তার শরীরের তাপমাত্রার সমতায় আসতে পারে না, তখন ব্যাঙটি ফুটন্ত পানির পাত্র থেকে লাফ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ততক্ষণে সময় শেষ। সে তখন লাফ দিতে পারে না, কারণ সে তার সমস্ত শক্তি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করে ফেলেছে। অতঃপর সে পানিতে সেদ্ধ হতে থাকে। তার মৃত্যুর কারণটা আসলে গরম পানি না, বিপদজনক পরিস্থিতির শুরুতে সেই পরিস্থিতি অস্বীকার করে লাফ না দেয়াটা তার মৃত্যুর কারণ। মানিয়ে নেবার, পাত্রের পানি গরম কেন তার প্রতিবাদ না করে বরং তার সাথে সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়াই তার জীবন্ত সেদ্ধ হবার কারণ।
সঠিক সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে না নেয়াই তার মৃত্যুর কারণ। হঠাৎ করে সেই সেদ্ধ হওয়া ব্যাঙের কথা মনে পড়লো। খুব সম্ভবত আমরাও ঐ ব্যাঙের মত মানিয়ে নিচ্ছি আমাদের চারপাশের সাথে। সহ্য করছি সব, আর ভাবছি টিকে আছি, টিকে থাকবো।
বর্তমানে দেশে ইয়াবার ছড়াছড়ি। এই মরণ নেশা দেশের তরুণ সমাজকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে চলেছে। ফলে পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে যে, ইয়াবার মরণ নেশায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম। এখনই যদি কার্যকরভাবে ইয়াবার প্রসার বন্ধ করা না যায়, তবে দেশের ভবিষ্যত তথা তরুণ প্রজন্ম অন্ধকারের পথেই এগিয়ে যাবে।
ইয়াবার ভয়াবহতা আমাদের এখনই বুঝতে হবে। অন্যথায় আমাদের অবস্থা বয়লিং ফ্রগ সিনড্রোমের মতো হবে। যখন বুঝবো, তখন সিদ্ধান্ত নেবার মতো কোন শক্তিই অবশিষ্ট থাকবে না।
অনেক তরুণী মনে করেন, ইয়াবা সেবন করে তারা নিজেদের আকর্ষণীয় করে রাখতে পারবেন। অনেকেই ইয়াবাকে যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট হিসেবে মনে করে থাকে। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান এই ট্যাবলেটের সাথে আকর্ষণীয় শরীর কিংবা যৌন উত্তেজনার কোন সম্পর্ক খুঁজে পায়নি। বরং দীর্ঘদিন সেবনের ফলে যৌন ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে থাকে।
নিয়মিত ইয়াবা সেবন করলে মস্তিস্কে রক্ত ক্ষরণ, নিদ্রাহীনতা, ক্ষুধামন্দা এবং মস্তিস্ক বিকৃতি দেখা যেতে পারে। ইয়াবা গ্রহণের ফলে ফুসফুস, বৃক্ক সমস্যা ছাড়াও অনিয়মিত এবং দ্রুতগতির হৃদস্পন্দনের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত হারে ইয়াবা গ্রহণ উচ্চ শারীরিক তাপমাত্রার কারণ হতে পারে। স্মরণশক্তি কমে যায়, সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয় এবং কারও কারও ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়।
ইয়াবা ব্যবহারকারী ধীরে ধীরে মানবতা ও ধৈর্যশীলতা হারিয়ে ফেলে। ইয়াবা সেবনে প্রচণ্ড ভাবে দীর্ঘ মেয়াদী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধিত হয়। শরীরের মাংশপেশী প্রবল ভাবে কামড়াতে থাকে। অনেকে পাগল হয়ে যায়। ডিপ্রেশন বা হতাশাজনিত নানা রকম অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, এমনকি অনেকে আত্মহত্যাও করে থাকে। এছাড়া হার্টের ভেতরে ইনফেকশন হয়ে বা মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়েও অনেকে মারা যান।
ইয়াবা নামক জীবননাশক মাদকের বিস্তার যেন আপনার সন্তানের মাধ্যমে পরিবারে ঢুকতে না পারে, সেই ব্যবস্থা দ্রুত করতে হবে। স্থানীয় সরকার অর্থাৎ বিভাগ, জেলা, থানা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড পর্যন্ত সমস্ত প্রশাসন এবং জন প্রতিনিধিকে নিজ নিজ এলাকায় মাদক দ্রব্য উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
পিতা-মাতা এবং অভিভাবকদের পরিবারের ছেলে-মেয়েদেরকে শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে যেন সন্তান কোনোভাবেই সঙ্গদোষ কিংবা অন্য কোন কারণে নেশায় আসক্ত হয়ে না পড়ে।
শুধু লেখাপড়ার মাঝে সন্তানদের আটকে না রেখে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার দিকে উৎসাহিত করতে হবে। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করবে এবং তাদের মত প্রকাশের সুযোগ করে দেবে। পিতা-মাতাকে সকল ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানদের সময় দিতে হবে। সন্তান যেন কখনও একাকিত্ব বোধ না করে, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি ভাবে সভা-সমাবেশ, সেমিনার, আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে ইয়াবার ভয়াবহতা ও এর প্রতিকারের ব্যাপারে অবগত করতে হবে।
ইয়াবায় আসক্তদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবারের কোন সস্তান যেন ইয়াবায় আসক্ত না পড়ে, সেই ব্যবস্থা পরিবার থেকেই করতে হবে। পারিবারিক জবাবদিহিতা জোরদার করতে হবে। তবেই ইয়াবা থেকে মুক্তি পাবে প্রতিটি পরিবার তথা দেশের তরুণ সমাজ, মুক্তি পাবে দেশ। এখানে কোন প্রকার শিথিলতা প্রদর্শন করার বিন্দু মাত্র সুযোগ নেই।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/রখ
riazul.haque02@gmail.com