প্রভাষ আমিনঃ বাংলাদেশে মানুষ বেশি। ইদানীং শিক্ষার হারও বেড়েছে। তাই বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। এই শিক্ষিত বেকাররা নানা দাবি নিয়ে প্রায়ই রাস্তায় নামে। কখনো কোটা সংস্কারের দাবিতে, কখনো চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে।
‘এমন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে মেয়েটি অন্তত আস্থা ফিরে পায়। যেন সে দেশ ছেড়ে যাওয়ার ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। এই দেশটি এই অল্প কয়েকটা শুয়োরের নয়; আমার, আপনার, আমাদের সবার, সেই মেয়েটিরও। আমার মায়ের জন্য, আমার বোনের জন্য, আমার কন্যার জন্য এই দেশটা নিরাপদ রাখতেই হবে।’
‘ছাত্র পরিষদ’এর ব্যানারে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে শিক্ষিত বেকাররা বেশ কয়েকদিন ধরেই আন্দোলন করছিল। ১০ মার্চ শনিবার সকালে তারা শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করে। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হয় স্মারকলিপি দিতে। রাজধানীর বাংলামোটরে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। পুলিশের বক্তব্য সোজা-সাপটা- ভিআইপি রাস্তা বা কোনো রাস্তা আটকেই কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেবেন না তারা। তাতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ হয়।
পুলিশের এই জনবান্ধব ভাবনায় আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। জনগণের বন্ধু পুলিশের তো এমনভাবেই ভাবার কথা, ভাবা উচিত। কিন্তু চট করে আমার মনে পড়ে যায়, দুদিন আগের কথা। ৭ মার্চ বুধবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের জনসভা ছিল। সেদিন পুলিশ বিনা নোটিশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানমুখী বেশির ভাগ রাস্তা আটকে দিয়েছিল। পুলিশের চেষ্টায় প্রায় অচল হয়ে গিয়েছিল রাজধানী। সেদিন পুলিশের এই জনবান্ধব ভাবনা কোথায় ছিল?
পুলিশ তো কোনো দলের নয়, দেশের। তাহলে বিএনপি ফুটপাতে দাঁড়াতে গেলেও পুলিশ বাধা দেয়, বেকার শিক্ষার্থীরা স্মারকলিপি দিতে গেলেও পুলিশ লাঠিচার্জ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমাবেশ হলে নিজেরাই রাস্তা আটকে রাখে। এরা আওয়ামী লীগের বন্ধু না শত্রু? পুলিশের পক্ষ থেকে ৭ মার্চের সমাবেশ ঘিরে জনদুর্ভোগের জন্য দুঃখও প্রকাশ করা হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে জনদুর্ভোগের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা সবসময় মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন। এ কারণে আওয়ামী লীগ সাধারণত সাপ্তাহিক কর্মদিবসে কোনো বড় রাজৗনৈতিক কর্মসূচি আয়োজন করে না। কিন্তু ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণ দলমত নির্বিশেষে বাঙালির সম্পদ, বিশ্বের সম্পদ। এই দিনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বিবেচনা করে বুধবার সেওহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়।’ আমি পুলিশকে দোষ দিচ্ছি না। তাদের তো নিজস্ব প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই তারা বাস্তবায়ন করে। সরকার যদি নিজেদের ভালোটা না বুঝে, পুলিশ কী করবে।
বাংলামোটর এলাকাটি এমনিতে খুব ব্যস্ত। সম্প্রতি ফ্লাইওভার চালু হওয়ার পর এই এলাকাটি আরো ব্যস্ত হয়ে গেছে। বাংলামোটর মোড়ের কাছে যাদের বাসা, তারা এখন আর গাড়ি নিয়ে ঘর থেকে বের হতে পারেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের বাসার গেটেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ফ্লাইওভার থেকে নেমেই সব গাড়ি থমকে যায় যানজটে। বাংলামোটর মোড়টি ভিআইপি রোডের অংশ। তাই এই এলাকার যানজট নিয়ন্ত্রণ এখন পুলিশের জন্য বাড়তি মাথাব্যথা।
বাংলামোটর সারাদেশে পরিচিত গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশের মার্কেটের জন্য। স্বাধীনতার আগে এই এলাকাটির নাম ছিল পাকমোটর, স্বাধীনতার পর বদলে হয় বাংলামোটর। তবে গত সপ্তাহে ভিন্ন কারণে আলোচনায় আসে বাংলামোটর। শনিবার চাকরির আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনরতদের মধ্যে অনেক নারীও ছিলেন। কিন্তু সেখানে কোনো নারী পুলিশ ছিল না। নারী বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেছেন, পুরুষ পুলিশ সদস্যরা তাদের ধাক্কা দিয়েছে, গায়ে হাত তুলেছে, হেনস্থা করেছে।
তাদের অভিযোগ শুনতে শুনতে আমার আবার চট করে দুদিন আগের, মানে ৭ মার্চের কথা মনে পড়ে গেল। ৭ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৭১ সালের এইদিনে তখনকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে ধারণ করেছিলেন বাঙালি জাতির ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস আর স্বাধীনতার আকাঙ্খা। এবার ৭ মার্চ এসেছিল ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে। গতবছর ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই স্বীকৃতির পর এবার প্রথম ৭ মার্চকে আওয়ামী লীগ পালন করেছে উৎসবমুখর পরিবেশে। কিন্তু সেই উৎসবের আমেজে, বাঙালির গৌরবে কলঙ্কের কালি মেখে দিয়েছে কয়েকটি মানুষরূপী জানোয়ার।
ভিকারুন্নিসা নুন কলেজের এক ছাত্রী তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শান্তিনগর মোড়ে এক ঘণ্টা দাড়ায়ে থেকেও কোনো বাস পাইলাম না। হেটে গেলাম বাংলামটর। বাংলামটর যাইতেই মিছিলের হাতে পড়লাম। প্রায় ১৫-২০ জন আমাকে ঘিড়ে দাড়াইলো। ব্যস! যা হওয়ার থাকে তাই। কলেজ ড্রেস পড়া একটা মেয়েকে হ্যারাস করতেসে, এটা কেউ কেউ ভিডিও করার চেষ্টা করতেসে। কেউ ছবি তোলার চেষ্টা করতেসে। আমার কলেজ ড্রেসের বোতাম ছিড়ে গেছে। ওড়নার জায়গাটা খুলে ঝুলতেছে। ওরা আমাকে ধাপড়াইসে। আমার শরীরে হাত দিসে। আমার দুইটা হাত এতগুলো হাত থেকে নিজের শরীরটাকে বাচাইতে পারে নাই। একটা পুলিশ অফিসোর এই মলেস্টিং চক্রে ঢুকে আমাকে বের করে এন্ড একটা বাস থামায়ে বাসে তুলে দেয়। বাকিটা পথ সেইফ্লি আসছি। প্রচন্ড শরীর ব্যথা ছাড়া আর কোনো কাটাছেড়া নাই। মেন্টালি ভয়াবহ বিপর্যস্ত বাট শারীরকভাবে ভালো আছি। আমি এই শুয়োরদের দেশে থাকব না। জয় বাংলা বলে যারা মেয়ে মলেস্ট করে তাদের দেশে আমি থাকব না। থাকব না। থাকব না… ।’
মেয়েটি আমার সন্তানের বয়সী। যে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মেয়েটি লিখেছে, তা এক ভয়ঙ্কর বাংলাদেশের ছবি। নারী দিবসের আগের দিন রাজপথে নারীর এই অবমাননায় আমি ক্ষুব্ধ, লজ্জিত। মেয়েটির কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাই। কিন্তু তাতে কি মেয়েটির মনের ক্ষত মুছবে? আমার কানে খালি বাজছে, থাকবো না, থাকবো না, থাকবো না…। একটি কলেজপড়ুয়া মেয়ে; যে বিতর্ক করে, লেখালেখি করে, নানা কর্মকান্ডে জড়িয়ে থেকে দেশকে বদলাতে চায়; সে যখন এই দেশ ছেড়ে যেতে চায় লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়।
এই মেয়েটির ফেসবুক স্ট্যাটাস ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। সন্ধ্যায় অন্তত আরো তিনজন একই ধরনের অভিযোগ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। একই ধরনের অভিযোগের স্ট্যাটাস দেখে কেউ কেউ সন্দেহ করেন অভিযোগের সত্যতা নিয়ে। অভিযোগকারীদের অস্তিত্ব নিয়ে। অনেকে সন্দেহ করেন, এসব ফেক একাউন্ট কিনা তা নিয়েও। অনেকেই বলছিলেন, সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করতে রাজনৈতিক উদ্দেশে এই সংগঠিত প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সবগুওেলা একাউন্ট চেক করে দেখিনি। তবে ভিকারুন্সিনসা কলেজের মেয়েটির একাউন্ট দেখে আমার ফেক মনে হয়নি। অভিযোগও মিথ্যা মনে হয়নি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও মনে হয়নি। বরং ‘রাজনৈতিক উস্কানিমূলকভাবে শেয়ার করা হচ্ছিল’ বলে মেয়েটি রাতে তার স্ট্যাটাসটি ‘অনলি মি’ করে রাখে। তবে তাতেও তো আর অভিযোগটি মিথ্যা হয়ে যায় না, হারিয়েও যায় না।
অভিযোগটি নিয়ে আমার একেবারেই সন্দেহ হয়নি। আমি জানি রাজনীতি অনেক আগেই পচে গেছে। আগে রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে নারীরা, মানুষেরা সবচেয়ে নিরাপদ থাকতো। এখন সংগঠিত রাজনৈতিক কর্মীরা ভয়ঙ্কর। নারীরা এখন রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে দূরে থাকেন। আমি নিশ্চিত এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু এতদিন মেয়েরা মুখ খোলেনি বলে জানতে পারিনি। বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক ‘মি-টু’ আন্দোলনের প্রভাবেই হয়তো বাংলাদেশের নারীরাও মুখ খুলতে শুরু করেছে। এ কারণেই আমরা জানতে পারছি, রাজনৈতিক ব্যানারে লুকিয়ে থাকা এই শুয়োরগুলো সম্পর্কে।
তৃণমূলের কর্মীরাই আওয়ামী লীগের প্রাণ। কিন্তু এটা আর অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই তৃণমূলে ভেজাল ঢুকে গেছে। সেই তৃণমূলের ওপর আর আওয়ামী লীগের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেই। সমাবেশ বড় করতে ভাড়া করে লোক আনা হয়। তারা দলের আদর্শ সম্পর্কে জানে না, ৭ মার্চের পবিত্রতা বোঝে না। তাদের কাছে নারী মানে, টিজ করার, হেনস্থা করার, গায়ে হাত দেয়ার সুযোগ।
অস্বীকার প্রবণতা আওয়ামী লীগের একটি অতি পুরোনো রোগ। ৭ মার্চের জনগণের দুর্ভোগের জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেও রাজপথে নারী হেনস্থা প্রসঙ্গ আসতেই অস্বীকার প্রবণতা পেয়ে বসেছে ওবায়দুল কাদেরকেও। তিনি বলে দিয়েছেন, সমাবেশের বাইরের কোনো ঘটনার দায় দলের নয়, সরকারের। অথচ ওবায়দুল কাদের ছুটে যেতে পারতেন মেয়েটির বাসায়। তাকে আশ্বস্ত করতে পারতেন, ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিতে পারতেন। তবে সরকারকে ধন্যকাদ। তারা দ্রুতই ব্যবস্থা নিয়েছে। পুলিশ মেয়েটির সাথে কথা বলেছে। মেয়েটির বাবা মামলা করেছেন। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে।
পত্রিকায় দেখলাম, কয়েকজনকে চিহ্নিতও করা হয়েছে। ১০ মার্চ পুলিশ রাজপথে নারীদের হেনস্থা করলেও ৭ মার্চ কিন্তু সেই পুলিশের এক সদস্যই মেয়েটিকে উদ্ধার করেছে। যে পুলিশ অফিসার মেয়েটিকে উদ্ধার করেছে, তাকে ধন্যবাদ। দাবি জানাচ্ছি, এই পুলিশ অফিসারের সহায়তায়, সিসিটিভি দেখে চিহ্নিত হওয়া শুয়োরগুলোকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক।
আমি জানি যে ক্ষত মেয়েটির মনে লেগেছে, তা কখনোই মুছবে না। তবুও এমন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে মেয়েটি অন্তত আস্থা ফিরে পায়। যেন সে দেশ ছেড়ে যাওয়ার ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। এই দেশটি এই অল্প কয়েকটা শুয়োরের নয়; আমার, আপনার, আমাদের সবার, সেই মেয়েটিরও। আমার মায়ের জন্য, আমার বোনের জন্য, আমার কন্যার জন্য এই দেশটা নিরাপদ রাখতেই হবে।