নজরুল ইসলাম জুলু : অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় ‘রাজশাহী’ শিক্ষা নগরী হিসেবে সারাদেশেই বহুল পরিচিত নাম। রাজশাহী জেলা শহর রাজশাহী মহানগরীতে প্রায় ৮টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রায় ১০টি সরকারি কলেজ, ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেসরকারি/এমপিওভূক্ত বিদ্যালয় ও কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি নার্সিং ইন্সটিটিউট, বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠান, কিন্ডারগার্টেন ও কোচিং সেন্টার অবস্থিত । অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা বান্ধব পরিবেশের কারণে তাই রাজশাহী শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার এই শহরে অনেকটা শাখা প্রশাখার মতোই গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন।
একটি নির্দিষ্ট শিক্ষা বছর শেষে ডিসেম্বর মাসে রাজশাহী সেজে উঠে কিন্ডারগার্টেন হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর আকর্ষণীয় ও চটকদার বিজ্ঞাপনের ব্যানার, ফেস্টুনে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠান পাড়া-মহল্লায় চটকদার ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আসছে। এসব বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে অভিভাবকরাও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তুলে দিচ্ছেন কিন্ডারগার্টেনগুলোর সংশ্লিষ্টদের হাতে।
অভিযোগ রয়েছে, এইসব বেসরকারি বিদ্যালয় গুলোতে ইচ্ছেমতো ভর্তি ফি, টিউশন ফি নির্ধারণ করে কর্তৃপক্ষ। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বাইরেও তিন থেকে পাঁচটি বই অতিরিক্ত পড়ানো হয়। সেজন্য কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বাড়তি ফিও আদায় করে থাকে। এছাড়াও, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাজেস্ট করা গাইড, বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামার বই ক্রয় করতে হয়। এমন কি শিক্ষার্থীদের কোন কালার পেনসিলের ব্রান্ড ক্রয় করতে হবে তার নামও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্ধারিত করে দেওয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছর জুড়েই এই সব প্রতিষ্ঠান গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ইচ্ছেমতো নিজেরাই সিলেবাস ও ফি নির্ধারিত করেন। যার থেকে যেমন খুশি অর্থ আদায় করা হয় বলেও জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায় বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি এসব কিন্ডারগার্টেনের কোনো কোনোটিতে ইংরেজি মাধ্যমও চালু রয়েছে। সেখানে প্লে-গ্রুপ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে। অথচ, অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানেরই সর্বোচ্চ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর নিয়ম রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কিন্ডারগার্টেনে যারা পাঠদান করছেন, তাদের অধিকাংশই কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী ।
প্রতিবছরই আধুনিক ও উন্নত শিক্ষা সেবা প্রদানের নামে এই প্রতিষ্ঠান গুলো ভর্তি ফি, আইডি কার্ড ফি, ইত্যাদি আরও ফি এর নামে অভিভাবকদের কাছ থেকে বাগিয়ে নিচ্ছে বিপুল অংকের অর্থ । সরেজমিনে দেখা যায়, কিন্ডারগার্টেনে যারা পাঠদান করছেন, তাদের অধিকাংশই কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী ।
অনুসন্ধানে জানা যায় ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গজিয়ে উঠা এই সমস্ত কিন্ডারগার্টেন গুলোর অধিকাংশই অনুমোদন ছাড়াই নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অনুমোদনহীন এই কিন্ডারগার্টেন গুলোর বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারীদের অভিযোগ তারা অনুমোদন চাইলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলো কার্যকর ভূমিকা পালন না করায় অনুমোদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য মতে, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা, ২০২৩ এর বিধি ৪ এর উপবিধি (৫) এর অধীন প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য (১ এক বছর মেয়াদি) ‘পাঠদান অনুমতি’ ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত রয়েছে মাত্র ২৬টি প্রতিষ্ঠানের। এইদিকে রাজশাহী কিন্ডার গার্টেন অ্যাসোসিয়েশন হতে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী , রাজশাহী জেলায় প্রাথমিক বেসরকারি স্কুল আছে প্রায় ৩০০টি এর মধ্যে রাজশাহী মহানগরীতে রয়েছে ৮৫টি। এ সকল প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানেরই পাঠ দানের অনুমতি নেই বলে রাজশাহী কিন্ডার গার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সূত্র মোতাবেক জানা যায়।
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের তথ্যমতে, মাধ্যমিক পর্যায়ে রাজশাহী জেলার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাঠদানের অনুমতি নিয়েছে মাত্র ৪২টি কিন্তু, পাঠদান করছে প্রায় ২৫০টি স্কুল।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদন নেই তারা নিকটবর্তী অন্য কোনো স্কুলের সঙ্গে যৌথভাবে স্কুল পরিচালনা করে। অভিযোগ রয়েছে সরকারি নিবন্ধন পাওয়া স্কুলের শিক্ষা তালিকায় অনুমোদনহীন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নাম দেখানো হয়। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষাতে তাদের অনুমোদিত বা নিবন্ধিত স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবেই অংশ নেয় এসব শিক্ষার্থী। এমনকি সরকারি বই পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই তারা বই পেয়ে থাকে বলেও জানা যায়।
রাজশাহী মহানগরীর সিএন্ডবি মোড়ে অবস্থিত বহুল পরিচিত ‘শিমুল মেমোরিয়াল নর্থ সাউথ স্কুল’ এর অনুমোদনের মেয়াদ ২০১৫ সালে শেষ হয়েছে এবং অনুমোদনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও প্রতিষ্ঠানটির ভর্তি কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে । তবে, স্কুলটির প্রধান শিক্ষক বিরাজ অহম্মেদ বলেন, এক বছরের জন্য আমরা আরও অনুমোদন নিয়েছি। আমাদের লটারির লিস্ট দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন না থাকলে আমরা কীভাবে ভর্তি নিচ্ছি? তাদের কাছে যথাযথ অনুমোদন রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
এইদিকে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক মো. অসলাম জানান তারা আবারো অনুমোদনের জন্য অবেদন করেছেন এবং তার প্রেক্ষিতেই এখন তারা ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
রাজশাহী জেলা প্রিক্যাডেট ও কিন্ডার গার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রফিক অলম বলেন,
আমরা চাচ্ছি খুব দ্রুত অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান গুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হোক। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের মনিটরিং প্রচণ্ড স্লো। তারা যদি একটু দ্রুত না করেন তাহলে আরও নতুন প্রতিষ্ঠান হবে।
রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এ.কে.এম আনোয়ার হোসেন বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তবে আমরা সবার জন্য পাঠদানের অনুমতি প্রক্রিয়া সহজ করে দিয়েছি। তারা আমাদের শর্ত পূরণ করলেই এটি পেয়ে যাবে।
রাজশাহী জেলা শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুল আজিজ সরদার বলেন, আমাদের মাধ্যমিকের পাঠদানের অনুমতি শিক্ষা বোর্ড থেকে নিতে হয়। কোনো স্কুল যদি সেটি না করে থাকে তাহলে আমরা তাদের বই দেবো না।
বিএ..