মাসুদা ভাট্টি: বিএনপি-চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাজা ঘোষিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত পক্ষে-বিপক্ষে যারা কথা বলছেন তারা মূলতঃ এ কথাটিই বলছেন যে, এই রায়টি রাজনৈতিক এবং আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে, আরেকটি পক্ষ বলছেন, এই রায় রাজনৈতিক নয়, দীর্ঘ ১০ বছর বিচারকার্য চলার পর যে রায় ঘোষিত হয় তাকে রাজনৈতিক রায় বলার সুযোগ নেই এবং আগামী নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না, পড়লেও সেটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
মজার ব্যাপার হলো, এই রায়কে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে যতোটা তোলপাড় হওয়ার কথা ভাবা গিয়েছিল তার কিয়দংশও হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ছবি অবমাননা এবং যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাই কমিশনে হামলা ছাড়া আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আর বিদেশিদের পক্ষ থেকেও সরকারের ওপর কোনো ভাবেই এই রায়ের বিষয়ে চাপ আসেনি, যেমনটি অনেকেই মনে করছিলেন। কিন্তু এদেশে বিদেশিদের যারা তল্পিবাহকের কাজটি করেন তারা মাতম করেই যাচ্ছেন যে, সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এই রায় দিয়েছে।
‘আজকে বিএনপি-র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, বেগম জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর ফলে দলটি আরো শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু একথা বলছে না যে, একদল মানুষ একথাও বলছে যে, যে দলটির প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যক্তি চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ এবং বিজ্ঞ বিচারক তাদেরকে এ জন্য শাস্তিও দিয়েছে, তাদের হাতে ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্ব আদৌ দেয়াটা সমীচীন হবে কি?’
কিন্তু তাদের মুখপাত্র পত্রিকাটি কিন্তু সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সে রকম কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না, বরং আদালতের প্রক্রিয়া, জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা অর্থ ও অর্থের ক্ষেত্রে ঘটা অনিয়ম, বিচারকার্যের দীর্ঘসূত্রিতা, বেগম জিয়ার পক্ষে আইনজীবীদের সর্বাত্মক চেষ্টা বিচার বন্ধ কিংবা আরো সময় ক্ষেপনের, এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের দেওয়া সকল তথ্য-উপাত্ত চুলচেরা বিশ্লেষণ সবই জনগণের সামনে সংবাদ হিসেবে তুলে ধরছে। কিন্তু যে মুহূর্তে এই মুখপত্রটির লেখক/বিশ্লেষককূল বেগম জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে তাদের বিশ্লেষণ হাজির করছেন, সেখানে তারা লাগামহীন মিথ্যাচারের সঙ্গে নানা ধরনের মনগড়া কথা দিয়ে এটাই প্রমাণ করতে চাইছেন যে, এই রায় রাজনৈতিক। কথা যদিও সত্য, কারণ বেগম জিয়া একজন রাজনীতিবিদ, তাই তার সম্পর্কে যে কোনো রায় বা পদক্ষেপই রাজনৈতিক হিসেবে গণ্য করা হবে, তাই নয় কি?
কিন্তু আমাকে আকৃষ্ট করছে আরেকটি বিষয়, যেখানে ডান-বাম-সুশীল সকলেই এক সুরে বলতে চাইছেন যে, মাত্র দুই-আড়াই কোটি টাকার জন্য বেগম জিয়াকে শাস্তি দেওয়া হলো কিন্তু কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যাংক লুটপাট কিংবা শিক্ষা খাতে অনিয়মের কেন কোনো শাস্তি দেওয়া হলো না? একথা কেউই অস্বীকার করছে না যে, এদেশের ব্যাংকিং খাত একেবারেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে, শিক্ষা খাতের কথা বলতেই চাই না, কারণ বললেই যে কথাটি জোর দিয়ে বলতে হবে যে, একজন ভদ্রলোক হিসেবে শিক্ষামন্ত্রীকে আর কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারা যায় না। এই দুই খাতসহ বাকি সব খাতেই দুর্নীতি ও অব্যবস্থার বিচার কেন হচ্ছে না তা নিয়ে আমার প্রশ্ন বহুদিনের এবং এ নিয়ে বিস্তর লিখেওছি।
কিন্তু তাতে কেন বেগম জিয়ার দুই/আড়াই কোটি টাকার দুর্নীতির (মনে রাখতে হবে যে, এই বিচার কিন্তু এতিমদের টাকা মেরে খাওয়ার জন্য নয়, রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে এতিমের হক থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ার জন্য) বিচার করা যাবে না? যারা এই প্রশ্ন তুলছেন তারা আসলে প্রথমে স্বীকার করছেন যে, বেগম জিয়া দুর্নীতি করেছেন এবং সেটা মাত্র দুই আড়াই কোটি টাকার, সুতরাং এই ছোট পরিমাণ টাকার দুর্নীতিকে অগ্রাহ্যই করা যায় যেহেতু এদেশে এই সরকারের আমলে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। যুক্তি হিসেবে এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় এ কারণে যে, দুর্নীতির ছোট-বড় নেই, যা হয়েছে যতোটুকু হয়েছে তা আমলে নিয়েই তার বিচার করতে হবে।
বাংলাদেশে এর আগে কোনো প্রধানমন্ত্রীর করা অনিয়মের বিচার হয়নি, এটা শুরু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে সকল প্রধানমন্ত্রীই এ বিষয়ে সতর্ক ও ভীত থাকবেন, তাতে উপকারটি জনগণেরই হবে। এবং তার চেয়েও বড় কথা হলো, এবার থেকে আমাদের হাতে নতুন অস্ত্র এলো সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের যে, আর অপেক্ষা করা যাবে না, এবার সরকারের সকল রাঘব বোয়ালদের দুর্নীতি তদন্ত করে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতেই হবে, নাহলে সামনে এর জন্য সরকারকে কঠিন মূল্য দিতে হবে। জানি না, বিএনপি-জামায়াত বা তাদের জন্য যারা এখন কেঁদে-কেটে একসা হচ্ছেন তারা কি সেটা বুঝে করছেন না না-বুঝে করছেন, বুঝে করলে কখনওই এই দাবি তুলতেন না যে, এতো অল্প টাকার জন্য বেগম জিয়াকে শাস্তি দেওয়া হলো কেন?
এই প্রশ্ন তোলার সঙ্গে সঙ্গে এটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, বেগম জিয়া অন্যায় করেছেন কিন্তু সেটা আসলে অল্প-স্বল্প। একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সামান্য অন্যায়ও যে রাষ্ট্রকে ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে তা ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমরা দেখেছি, গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল, কেউ আর থামানোর ছিল না কারণ রাষ্ট্রের প্রধানতম ব্যাক্তি ও তার পরিবারের সদস্যরাই যখন দুর্নীতি করে তখন বাকিরা আর বসে থাকবে কেন?
কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে আজ অবধি আমরা এখানেই সান্ত্বনা খুঁজে পাই যে, রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভে এখনও দুর্নীতি ঢোকেনি, আর ঢোকেনি বলেই ব্যাংকিং খাত সহ সকল খাতেই দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, হয়তো সময় ক্ষেপণ হচ্ছে কিন্তু অচিরেই আমরা হয়তো দেখবো যে, বড় বড় কিছু রাঘববোয়াল দুর্নীতি দমন কমিশনের জালে আটকা পড়েছে। আজকে যারা বেগম জিয়ার বিচারে নাখোশ হয়েছেন তারা কি তখন খুশি হবেন? আপাততঃ সেদিনটির অপেক্ষায় থাকা যাক।
ফিরে আসি রাজনীতির কথায়। আগেই বলেছি যে, বেগম জিয়া যেহেতু একজন রাজনীতিবিদ, সেহেতু তার বিচার কিংবা তাকে নিয়ে যে কোনো ঘটনাই রাজনৈতিক। না চাইলেও এতে রাজনীতির রঙ লাগানোর মানুষের অভাব পড়বে না। কিন্তু বিএনপি নামক দলটি যে এখনও অবধি একটি সত্যিকার রাজনৈতিক দল-এ পরিণত হতে পারেনি তার প্রমাণ তারা দিয়ে থাকেন যেদিন থেকে তারা বিরোধী দল হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন সেদিন থেকেই। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল, জোর করে তাদেরকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ১১ বছর নিয়মতান্ত্রিক ভাবেই বিএনপি রাজনীতির বাইরে আছে, কেউ তাদের জোর করে রাখেনি, আওয়ামী লীগকে যেমন ১৫ আগস্ট বা ২১ আগস্টের মোকাবিলা করতে হয়েছে অথবা একের পর এক নেতাকে হারাতে হয়েছে, শিকার হতে হয়েছে হত্যা কিংবা হামলার, চরিত্র হননের তেমনটি এখনও পর্যন্ত বিএনপিকে সামলাতে হয়নি।
শুরু থেকেই দলটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক, ক্ষমতায় গেলেই দলটি বিকশিত হয় কিন্তু যে মুহূর্তে তারা বিরোধী দলে যায় সেই মুহূর্তেই দেখা যায় যে, তারা আসলে ক্ষমতাহীন একটি প্ল্যাটফরম। জনগণ কিংবা বিদেশের কোনো শক্তি যদি দয়া করে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয় তবেই তারা ক্ষমতায় যেতে পারে, নাহলে নয়। এ পর্যন্ত নির্বাচনে বিজয় লাভ করে ক্ষমতায় যাওয়া বিএনপি’র ইতিহাস দেখুন, প্রতিটি নির্বাচন সামান্য হলেও প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিরোধী দলে গিয়ে তারা কেবলই ক্ষমতায় যাওয়ার ফাঁক-ফোঁকড় খুঁজেছে, প্রকৃত গণ-আন্দোলন বলতে যায় বোঝায় তা তারা করে দেখাতে পারেনি।
কিন্তু এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ইতিহাস ভিন্ন, দলটি বিরোধী দলেই যেনো সর্বোচ্চ শক্তিময়তা দেখাতে পারে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদের মাধ্যমে দাবী আদায় করে ছাড়তে পারে কিন্তু সরকারে গেলে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে করতেই তাদের ক্ষমতা-ক্ষয় হতে থাকে। দুঃখজনক হলো, ১১ বছর ধরে বিরোধী দলে থেকেও বিএনপি নামক দলটি বিরোধী দলের দায়িত্বটুকু শিখে উঠতে পারেনি। রাজনীতি যে কেবল ক্ষমতা নয়, বিরোধী দলে থেকেও করা যায় সেটা কি বিএনপি এবার শিখবে? অবস্থা দেখে সেটাও মনে হচ্ছে না।
আজকে বিএনপি-র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, বেগম জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর ফলে দলটি আরো শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু একথা বলছে না যে, একদল মানুষ একথাও বলছে যে, যে দলটির প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যক্তি চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ এবং বিজ্ঞ বিচারক তাদেরকে এ জন্য শাস্তিও দিয়েছে, তাদের হাতে ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্ব আদৌ দেয়াটা সমীচীন হবে কি? বিএনপি নামক একটি বৃহৎ দল এই দ্বিতীয় সত্যটি কি শুনতে পাচ্ছে বা আমলে নিচ্ছে? মনে হয় না। নিলে তারা কোনো ভাবেই গঠনতন্ত্র সংশোধন করে তারেক জিয়াকে দলের প্রধান হবার সুযোগ করে দিতো না। এই দলটি এখনও একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা করে চলেছে, জানি না কতোদিন পারবে।
এদেশের মানুষ জেলে যাওয়া রাজনীতিবিদদের জন্য সহমর্মিতা দেখায় ঠিকই কিন্তু দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত কারো ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেবে কিনা তা নিয়েও যে সন্ধিহান সেটা প্রমাণিত হয় এটা দেখেই যে, যতোটা প্রতিবাদ বেগম জিয়ার জেলে যাওয়ার ফলে হওয়ার কথা ছিল সেটা হয়নি। আর বিএনপি’র বিদেশি মিত্ররা কোনো ভাবেই দলটির নেতাদের এই দুর্নীতির বোঝা নেবে না তা তাদের আচরণেই প্রমাণ করে দিয়েছে। বেগম জিয়ার রায়কে ঘিরে ডাকা কোনো আমন্ত্রণেই এদেশের কোনো মিশন-প্রধান হাজির হননি, পাঠিয়েছেন মিশনের রাজনৈতিক এ্যাটাসে বা কাউন্সিলরদের। এগুলো একটি রাজনৈতিক দলের জন্য মেসেজ, যে দলটি এসব বুঝতে পারবে তারা আগামীতে রাজনীতিতে টিকে যাবে, নাহলে এদেশে রাজনৈতিক দলের পতনের ইতিহাস ভূরি ভূরি রয়েছে। প্রশ্ন হলো, এই রায় থেকে বিএনপি বা এদেশের রাজনীতি কী শিখবে? কতোটুকু শিক্ষা নেবে?
খবর২৪ঘণ্টা.কম/রখ
masuda.bhatti@gmail.com