জব্বার হোসেন, আপনাকে দেখতে যত স্মার্ট মনে হয়, তত স্মার্ট নন। যত আধুনিক মনে হয়, তত আধুনিক নন। উদার মনে হয়, তত উদার নন। আপনি রক্ষণশীল- নিজের সম্পর্কে অমন মন্তব্য শুনে মোটেও ভাবিত নই আমি। বিচলিত নই, বিব্রত নই। বরং যারা উদারতা, আধুনিকতা, স্মার্টনেসের অদ্ভুত সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছে, ভুল ব্যাখ্যার বয়ান করছে, তাদের নিয়ে রীতিমত আমি চিন্তিত।
এবার থার্টি ফার্স্ট নাইটে যে কটি নেমতন্ত পেয়েছি, তার সব ঘুরে ফিরে একই। থার্টি ফার্স্ট উপলক্ষ্য, মদ খাওয়াটাই লক্ষ্য। মদ খাওয়ার পার্টি, কেন যেন আমাকে টানে না বরাবরই। আমার কাছে পার্টি, সোশ্যাল গেদারিংয়ের যে জায়গাটি আকর্ষণ করে তা হলো- মানুষ, মানুষের সহচর্য, অন্যমত, ভিন্নমত, মানুষে মানুষে আলাপ, আলিঙ্গন। আমার বিচিত্র মানুষ, মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস, তার অন্তর্গত জগত, জীবনের বোধ- গভীরতাটুকু বোঝার চেষ্টা করতে, স্পর্শ করতে ভালো লাগে । মানুষকে পড়বার চেয়ে, মানুষের ভেতরের মানুষকে আবিস্কারের চেয়ে, আনন্দের আর কিছু নেই। মদের পার্টিতে সে সুযোগ কোথায়? কেউ দু’তিন পেগ পড়ার পর, কেউবা তারও আগে, মদের ঘ্রাণেই অপ্রকৃতস্থ।
‘ফ্রি সেক্স’ বলে বাইরে কোথাও কোন টার্ম নেই। আছে ‘ফ্রিডম অব সেক্স’। যৌনতার স্বাধীনতা। যার অর্থ ধস্তাধস্তি নয়, জোর জবরদস্তি নয়, ধর্ষণ নয়। কেউ না চাইলে অবশ্যই নয়। বিদেশের দোহাই দিয়ে দেশে যেকোন অসভ্যতা, বর্বরতা করতে চাওয়ার অজুহাত অন্তত আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য
এখানে কথাকথিত প্রগতিশীলেরা উদারতা, আধুনিকতা, স্মার্টনেসের বড় অদ্ভুত সব সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন। মদ খাওয়ার সঙ্গে উদারতা, আধুনিকতার কী সম্পর্ক আর না খাওয়ার সঙ্গে রক্ষণশীলতার সম্পর্ক কী তারাই ভালো জানেন। কেউ কেউ তো বলেই বসেন, আপনি কেমন নারীবাদী, মেয়েদের মদ খাওয়া, সিগারেট খাওয়াকে কে সমর্থন করেন না? পুরুষেরা মদ সিগারেট খেলে মেয়েরাও খাবে- এটা অধিকার তাদের। আমার খুব মূর্খ মনে হয় এদের। এরা ট্রেন্ডি পোশাক পড়াকে আধুনিকতা মনে করে। আধুনিকতা পোশাকে থাকে না, থাকে মগজে। চেতনায়, চিন্তায়। আমি নারী কেন, নারী-পুরুষ কারোই সিগারেট খাওয়া, মদ গেলাকেই সমর্থন করি না, কেননা এটি স্বাস্থ্যপ্রদ নয়, স্বাস্থ্যহানি কর। পুরুষ একটি অন্যায় করলে, ভুল করলে, অকাজ করলে নারীকেও তা প্রতিযোগিতামূলকভাবে করতে হবে, এ আর যাই হোক নারীবাদ নয়।
আজকাল এ শহরে পার্টির কথা বলে যা হয়, তা রীতিমত ‘ডার্টি পার্টি’। এক রাতে ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে ৫০ লাখ উঠে আসে। কখনও কখনও আরও বেশি। দেখতে সুন্দর, শরীর আকর্ষণীয় এমন অনেক মেয়েরা নিজেদের ‘পার্টি গার্ল’ পেশায় নিয়ে এসেছে। এরা মূলত ভাড়াটে। পুঁজির বিকার বলে একটি কথা রয়েছে। উৎপাদনহীন, ব্যবসাহীনভাবে প্রচুর টাকা উপার্জন করছে একটি শ্রেণি। এই শ্রেণিটি মূলত লুটেরা। তারা দখলদার। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এমন অনেক কিছু চলে যাচ্ছে তাদের দখলে। তাদের ভোগবাদিতার উপযোগ হচ্ছে এই মেয়েরা। এরা সারাদিন ঘুমোয়, বাড়িতে থাকে, উঠে সন্ধ্যায়।
এই পুতুল, পাপেট মেয়েরা নিজেদের সঙের মত করেই তৈরি করেছে। জ্ঞান নেই, মেধা নেই, কিন্তু কি করে কাটা চামচ ধরতে হয়, কি করে ওয়াইনের গ্লাসে হাত রাখতে হয়, এসব পোশাকী এটিকেট মুখস্থ করেছে। দু’চার লাইন ‘এক্সকিউজ মি’, ‘ওহ নো, ওহ ইয়েস’ জাতীয় ইংরেজিও রপ্ত করেছে। এই মেয়েরা সন্ধ্যে থেকেই মেকআপ নিতে বসে, ফলস পরে, উইগ পড়ে পুতুলের মতো করে নিজেকে সাজায়। গাড়ি আসলে, পার্টিতে চলে যায়। পার্টির জন্যই এদের ভাড়া করা হয়। পার্টি যতক্ষণ, ততক্ষণ, এর বেশি নয়, বেশি কিছু নয়। এর বেশি কিছু চাইলে, মিটার যায় বেড়ে। সে অন্য হিসেব।
থার্টি ফার্স্ট নিয়ে আমার যে উচ্ছ্বাস নেই তা নয় কিন্তু। আমার কাছে আনন্দ, উচ্ছ্বাসের অর্থ অসভ্যতা নয়, অমানবিকতা নয়, আদিম বরবর্তা নয়। থার্টি ফার্স্ট নাইটে টিএসসি চত্বরে, বাধনকে শ্লীলতাহানি, যৌন হয়রানির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। যে কোন উৎসব, আয়োজনকে উপলক্ষ করে মদ খেতেই হবে, অমনটিতে আমার আপত্তি। অনেকে কথায় কথায় বিদেশের কথা বলেন। বলেন, আরে ভাই বিদেশে এসব ফ্রি। ফ্রি সেক্স। ফ্রি মদ। খুব ভুল। খুব বাজে কথা। বিদেশে ‘ড্রাংক’ শব্দটি গালি হিসেবে, মন্দ হিসেবেই লোকে ব্যবহার করে। ভালো শব্দটি দুনিয়ার সকল ভাষাতেই ভালো, মন্দ সবখানেই মন্দ।
‘ফ্রি সেক্স’ বলে বাইরে কোথাও কোন টার্ম নেই। আছে ‘ফ্রিডম অব সেক্স’। যৌনতার স্বাধীনতা। যার অর্থ ধস্তাধস্তি নয়, জোর জবরদস্তি নয়, ধর্ষণ নয়। কেউ না চাইলে অবশ্যই নয়। বিদেশের দোহাই দিয়ে দেশে যেকোন অসভ্যতা, বর্বরতা করতে চাওয়ার অজুহাত অন্তত আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য। আমি নিজেও দেশের বাইরে পড়তে গিয়েছি। আমেরিকায় এখনও, ২১ বছরের নিচে যে কারও মদের বারে প্রবেশের অনুমতি নেই। এখানে নাইন, টেনের অনেক স্কুলের ছেলেরা হরহামেশাই মদের বারে যাচ্ছে। গিয়ে গিয়ে অভ্যেস তৈরি হচ্ছে; যা বাইরের দেশে এ বয়সে চিন্তাও করতে পারে না কেউ।
আমার নিজের জীবনে কখনওই মদের গ্লাস হাতে নেইনি, ছুঁয়ে দেখিনি, অমন নয়। হয়তো কখনও সখনও ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়েছি নেহাত বুঝবার জন্য। তবে এই টুকু বুঝেছি, এই মাত্রা বেশি হলে নিজের বোধ, বিবেচনা ঠিক থাকা মুশকিল। থার্টি ফার্স্ট আমার কাছেই অবশ্যই আনন্দের। আবার বেদনারও বটে। রাতের শেষ, দিনের শুরু। এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণ। কী হারালাম, কী পেলাম, যোগ-বিয়োগের ফল। আমি তো দেখতে চাই, শুনতে চাই, অনুভব করতে চাই, চাই স্পর্শ করতে -এই সন্ধিক্ষণকে। মদের নেশায় চুর হয়ে থাকলে তা কী করে সম্ভব?
আসুন, জীবনের উচ্ছ্বাসে মেতে উঠি, মাতাল হই, এগিয়ে যাবার আকাঙ্খায়।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/রখ