খবর২৪ঘণ্টা.কম, ডেস্ক: মানুষের বেঁচে থাকার জন্য হার্ট বা হৃদযন্ত্রকে সুস্থ-স্বাভাবিক বা ভালো রাখা জরুরি। হার্ট ভালো না থাকলে বিশেষ করে হার্ট ব্লোক হলে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই বেঁচে থাকতে ও সুস্থ থাকতে হার্টকে ভালো রাখতেই হবে। এ জন্য কী কী করবেন- এ নিয়ে ভারতের হার্ট বিশেষজ্ঞ ও সার্জন কুণাল সরকার একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকাকে। শীর্ষনিউজ পাঠকদের জন্য সেটি তুলে ধরা হলো-
প্র: আমরা জানতাম রক্তে কোলেস্টেরল বেশি থাকা হার্টের পক্ষে বিপজ্জনক৷ এখন শুনছি তা না থাকলেও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে?
উ: যত জন মানুষ ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ বা তার পরিণতিতে হার্ট অ্যাটাকে ভোগেন, তার মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশের কোলেস্টেরল বেশি থাকে৷ কাজেই বুঝতেই পারছেন, কোলেস্টেরল মাপে মাপে থাকলেই আপনি নিরাপদ, এমন নয়৷
প্র: সুগার ঠিক থাকলেও তো হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে দেখা যাচ্ছে৷ তা হলে?
উ: ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে সুগারের মাত্রা ঠিক থাকা আর সব কিছু আয়ত্তে থাকা এক নয়৷ কাজেই শুধু সুগার মাপলে হবে না৷ বছরে এক বার হার্ট, কিডনি, চোখ ইত্যাদি ঠিক আছে কি না দেখে নিতে হবে৷ কারণ এই রোগ এমনই যে তলে তলে সব প্রত্যঙ্গকে খারাপ করে৷ তার পর এক দিন আচমকা বড় বিপদ ঘটে যায়৷ রোগ পুরনো হলে তো বিশেষ করে৷
প্র: হার্ট খারাপ হচ্ছে কি না জানতে কী করতে হবে?
উ: বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি, ট্রেডমিল টেস্ট ও কিছু রক্ত পরীক্ষা করে দেখে নিতে হবে সব ঠিক আছে কি না৷
প্র: এ সব ঠিক থাকলে আর ভয় নেই?
উ: ঠিক তা নয়৷ যা-ই করুন না কেন, ডায়াবেটিস থাকলে হার্ট-সহ শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গগুলি একটু একটু করে খারাপ হবে৷ সতর্ক হয়ে চললে, আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে এই যে আচমকা হার্ট অ্যাটাক হয়ে স্থায়ী জখম হচ্ছে, কি খারাপ পরিস্থিতিতে প্রাণ চলে যাচ্ছে, তা ঠেকানো যাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে৷
প্র: কী ব্যবস্থা নিতে হবে?
উ: ব্যবস্থা তো নির্ভর করে অবস্থার উপর৷ সেটা প্রয়োজনমতো করা যাবে৷ কিন্তু আমরা চাই মানুষ এমন ভাবে চলুন যাতে কঠিন অবস্থায় তাঁকে না পড়তে হয়৷
প্র: কী রকম?
উ: প্রথম কাজ খাওয়া–দাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ আনা৷
প্র: নিয়ন্ত্রণ বলতে ফ্যাট জাতীয় কিছু না খাওয়া তো? ঘি–মাখন বাদ দেওয়া, তেল কম খাওয়া, এ সব আজকাল সবাই জানেন৷
উ: ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ বা হার্ট অ্যাটাকের জন্য সব ফ্যাটকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটাই হল বড় ভুল৷ তা হলে তো বরফের দেশের মানুষেরা সব দলে দলে মারা যেতেন৷ কারণ তাঁদের খাবারে ৯০ শতাংশের মতো ফ্যাট থাকে৷ তাঁদের কিন্তু হৃদরোগ হয় না বললেই চলে৷ কাজেই রোজ রোজ তেল–ঘিয়ে ঠাসা খাবার খাবেন না ঠিকই, কিন্তু উপকারী ফ্যাট কিছু খেতেই হবে৷ এরা হার্টকে খারাপ করার বদলে রক্ষা করবে৷
হার্ট ভাল রাখতে রোজ অল্প করে খেতে পারেন কাজু, অ্যালমন্ড, আখরোট, ব্রাজিল নাট
প্র: ফ্যাট রক্ষা করবে হার্টকে?
উ: ভাল ফ্যাট করবে বইকি৷ রোজের খাবারে তাই অল্প করে সব রকম বাদাম রাখুন৷ কাজু, অ্যালমন্ড, আখরোট, ব্রাজিল নাট থেকে শুরু করে চিনেবাদাম পর্যন্ত৷ তেল দিনে ৩–৪ চামচের বেশি খাবেন না ঠিকই, কিন্তু ভাল ফ্যাটের যোগান পেতে সব ধরনের তেল মিলিয়ে–মিশিয়ে খাবেন৷ যেমন সর্ষে, বাদাম, অলিভ, রাইসব্রান, সয়াবীন, সূর্যমুখী৷ এক এক দিন এক এক তেলে রান্না করলে হার্ট ভাল থাকবে৷ আর শুনলে অবাক হবেন, ঘি–মাখনও পুরো বাদ দেওয়ার দরকার নেই৷ সপ্তাহে তিন–চার দিন আধ চামচ খেলে ভালই হবে৷
প্র: কিন্তু আমরা তো আজকাল মাখনের বদলে মার্জারিন খাই৷
উ: ভুল করেন৷ বিপদ তাতেই বাড়ে৷
প্র: তাই না কি! আর তৈলাক্ত মাছ-মাংস খেলে?
উ: সপ্তাহে দু’–এক দিন তৈলাক্ত মাছ অবশ্যই খাবেন৷ সামুদ্রিক মাছ খাবেন মাঝেমধ্যে৷ রেডমিট ন’মাসে-ছ’মাসে খেলে কোনও ক্ষতি নেই৷
প্র: এ তো ফ্যাটে ফ্যাটে ছয়লাপ হয়ে গেল সুষম খাবারের হিসেবে (৬০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ২০ শতাংশ প্রোটিন ও ২০ শতাংশ ফ্যাট) গোলমাল হয়ে যাবে যে!
উ: এ হিসেব তো বদলে গেছে কবে! নতুন হিসেব হল ৪০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ২৫–৩০ শতাংশ প্রোটিন ও ৩০–৩৫ শতাংশ ফ্যাট৷
প্র: তা হলে কি স্বাভাবিক দুধ–দই খাওয়া যাবে?
উ: অবশ্যই যাবে৷ ডাবল টোন্ড বা স্কিম্ড মিল্ক প্রসেস করে বানানো হয়৷ যত প্রসেস্ড খাবারের দিকে ঝুঁকবেন, তত বিপদ৷
প্র: ডিমের কুসুম?
উ: সপ্তাহে গোটা তিনেক ডিম আরামসে খেতে পারেন৷
প্র: ওজন বেড়ে যাবে না? হার্টের জন্য সে-ও তো একটা রিস্ক ফ্যাক্টর!
উ: সাধারণ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ দিনে যে ২০০০ ক্যালোরির মতো খাবেন, তার মধ্যেই এ সব ফিট করে যাবে৷ কমাতে হবে সিম্পল কার্বোহাইড্রেট, যেমন ভাত, রুটি, ময়দা, মিষ্টি৷ তার বদলে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, যেমন, শাক–সব্জি–ফল খাওয়া বাড়াবেন৷ খেয়াল রাখবেন, বিএমআই বা বডি মাস ইনডেক্স যেন ২৫–এর খুব উপরে না ওঠে আর মহিলা হলে কোমরের মাপ থাকে ৩৬ সেমি আর পুরুষ হলে ৪০ সেমি–র মধ্যে৷
প্র: সাধারণ বাঙালি খাবারে তো ভাত–রুটিরই ছড়াছড়ি৷
উ: সঙ্গে আছে মিষ্টিমুখ করানোর অভ্যাস৷ সে জন্যই তো এত মানুষ ডায়াবেটিসে ভোগেন৷ হৃদরোগের চিকিৎসা করাতে যত জন আসেন তার মধ্যে ৩০–৪০ শতাংশই ডায়াবেটিক৷
প্র: তার মূলে কি ভাত–রুটি–মিষ্টির হাত আছে নাকি?
উ: খানিকটা তো আছেই৷ অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট খাওয়া ও শুয়ে–বসে থাকা ডায়াবেটিসের অন্যতম রিস্ক ফ্যাক্টর৷
প্র: ভাত–রুটি খাওয়া ছেড়ে দিলে?
উ: ছেড়ে দেবেন কেন? এখন যা খাচ্ছেন তার চেয়ে কমিয়ে দিন৷
ক্যালোরি কমাতে রোজ ঘণ্টা দুয়েক জোর কদমে হাঁটুন।
প্র: ভাত–রুটি বেশি খেয়ে যদি ব্যায়াম করে ক্যালোরি পুড়িয়ে দিই?
উ: ক্যালোরি পোড়ানো কিন্তু কঠিন কাজ৷ এক থালা ভাত বা হাবিজাবি খেয়ে ১০ মিনিট হেঁটে যদি ভাবেন কাজের কাজ করলেন, ভুল হবে৷ একটা হিসেব দিলে বুঝবেন৷ এক ক্যান কোল্ডড্রিঙ্ককে পুড়িয়ে নিঃশেষ করতে গেলে আধ ঘণ্টা জোরে ছুটতে হয় নয়তো জোরকদমে হাঁটতে হয় দু’ ঘণ্টা৷ একটা বড় মাপের পিৎজা, এক প্যাকেট চিপ্স বা এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানিকে সামলাতে এক ঘণ্ঢা দৌড়তে হয়, নয়তো হাঁটতে হয় ৩ ঘণ্টা৷ কাজেই বুঝতেই পারছেন খাবারের ক্যালোরি কন্ট্রোল কত জরুরি৷
প্র: ক্যালোরি কন্ট্রোল করলে আর তবে ব্যায়াম করতে হবে না?
উ: করতে হবে৷ ঘরোয়া কাজ, সিঁড়ি ওঠানামার পাশাপাশি সপ্তাহে অন্তত চার দিন কম করে ১৫–২০ মিনিট জোর কদমে হাঁটুন৷ এর বেশিও করতে পারেন৷ তবে এটুকু অন্তত না করলে চলবে না৷
প্র: এত কিছু মেনে চলার পরেও নিশ্চয়ই বছর বছর পরীক্ষা করাতে বলবেন?
উ: প্রেশার, সুগার, ওবেসিটি ইত্যাদি না থাকলে দু’বছর অন্তর কিছু পরীক্ষা করাতে হবে৷ তাতে এমন কিছু খরচ নেই৷ কিন্তু কোনও সমস্যা হতে চলেছে কি না জানতে পারলে হার্টকে আর অযথা ধাক্কা খেতে হয় না, এই আর কি৷
হার্ট বাঁচাতে কী খাব, কখন খাব
ক্স যতটুকু না খেলেই নয়, ঠিক ততটুকু খান৷ সামান্য জলও বেশি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভাল নয়৷
ক্স খারাপ কার্বোহাইড্রেটের জায়গায় ভাল ফ্যাট আনুন খাদ্যতালিকায়৷
ক্স ব্রেকফাস্ট সাহেবি কেতা নয়৷ অর্ধেক দিনের শক্তির যোগানদার৷
ক্স সারা দিনে ২০০০ ক্যালোরির মতো খাবার খাওয়ার কথা৷ তার সিংহভাগ ডিনারের জন্য না রেখে সারা দিন ধরে ভাগ করে খান৷
ক্স প্রচুর খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লে ক্যালোরির অনেকটাই ফ্যাটে পরিণত হয়ে বিপদ বাড়ায়৷
ক্স অল্পস্বল্প স্যোশাল ড্রিঙ্কিংয়ে বাধা নেই৷ কিন্তু ধূমপান ছাড়তে হবে৷
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ