নাটোর প্রতিনিধি: সেবার পাশাপাশি সিলিন্ডার বাণিজ্যের নাটোরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের নামে অভিযোগ উঠেছে। কোটি টাকার বানিজ্য অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার বিক্রি করে নির্ধারিত মুল্যের চেয়ে বেশী দামে বিক্রি কয়েক বছরে । এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে দুদক বরাবর ।
নাটোরের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে সেবা দিয়ে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা । ফায়ার সার্ভিসের নাটোরে উপ-সহকারী পরিচালক আকতার হোসেন ও সহকারী ফায়ারম্যান সাইফুল ইসলামের কারণে জন বান্ধব এই বাহিনীর নিবেদিত প্রাণ সদস্যদের কর্মতৎপরতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ । এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিনগুইসার) বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। শুধু কি তাই, যন্ত্রটির বাজার মূল্যের যা তার চারগুণ দামে বিক্রি করে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে , লাইসন্সে নবায়ন, অগ্নি নির্বাপক উপকরণ রিফিলে অতিরিক্ত ফি আদায় ও প্রতারণার অভিযোগও রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এসব কর্মকান্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন , দোকান মালিক, ক্লিনিক, হাসপাতাল, জুয়েলার্স, পেট্রোল পাম্প ও ইটভাঁটাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা।
গত কয়েক বছর ধরে নাটোরে ৭টি উপজেলার বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠারকে ৮৫০ টাকা মূল্যের ৫ লিটার এবিসি অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার কিনতে হয়েছে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দিয়ে। এছাড়া প্রতি সিলিন্ডার রিফিলের স্বাভাবিক চার্জ ১২৫ থেকে ১৫০ টাকা হলেও এক্ষেত্রে আদায় করা হয়েছে ৭০০ টাকা থেকে ১০০০( হাজার) টাকা পর্যন্ত। এভাবেই কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় নাটোর ফায়ার সার্ভিসের ওই দুই কর্মকর্তা। এ নিয়ে গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশন, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ও রাজশাহী বিভাগীয় উপ-পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন এক ভুক্তভোগি।
বাগাতিপাড়া উপজেলার গোলাম মোর্শেদ অভিযোগে করে জানান, নাটোরের ৭টি উপজেলায় বিধি না মেনে উপ-সহকারী পরিচালক আকতার হোসেন ও সহকারী ফায়ারম্যান সাইফুল ইসলাম অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র বিক্রিয় করছেন। আবার রিফিলও করছেন অতিরিক্ত টাকা নিয়ে। এভাবে কয়েক বছরে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা দু’জন। সরকারী গাড়ি ব্যবহার করে বিভিন্ন উপজেলার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক, হাসপাতাল, জুয়েলার্স, পেট্রোল পাম্প, ইটভাঁটাগুলোতে অভিযুক্ত আকতার হোসেন ও সাইফুল ইসলাম নিজেরাই স্ব-শরীরে গিয়ে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন-২০০৩ এর আলোকে প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র ক্রয়ের পরামর্শ দেন অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ক্রয় করার জন্য তারা। ভুক্তভোগীর ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের রাজশাহী বিভাগীয় অফিস। তবে তদন্তে প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যান তারা। তারপর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন তারা।
অভিযোগের পেক্ষিতে অনুসন্ধান করে , কয়েক দিন আগের সেবার আড়ালে সিলিন্ডার বাণিজ্যের চিত্র বেড়িয়ে আসে। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন-২০০৩ এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন বিধিমালা-২০১৪ অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট ফায়ার সার্ভিস অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে শুধু উদ্দীপনা মূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করবে। অথচ অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন-২০০৩ এর ১৯ থেকে ২১ ও ২৩ ধারা অনুযায়ী দাহ্যবস্ত্র সংরক্ষণ, প্রক্রিয়া করণ, যাচাই করণ, সংকোচন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাজে বাঁধাদান, ইতোপূর্বে শান্তির বিধান সাপেক্ষে শান্তি না দেয়া হলে শাস্তির ব্যবস্থাজনিত কারণে সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। মূলত এই ৪টির ধারার অপপ্রয়োগের মাধ্যমেই হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কয়েক কোটি টাকা।
অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের আমদানী, সরবরাহ ও রিফিলকারী প্রতিষ্ঠান নিউটেক্স ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্টের মূল্য তালিকা অনুযায়ী ২.৫ কেজি, ৩ কেজি, ৪ কেজি, ৫ কেজি ও ৬ কেজির এবিসি সিলিন্ডারের মূল্য যথাক্রমে ৩৫০, ৫৫০, ৭০০, ৮৫০ ও ১০৫০ টাকা। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে প্রতিটি নির্বাপক যন্ত্রের রিফিল ব্যয় ওজন ভেদে ১২৫ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। অর্থাৎ নাটোরে এর ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, ৫ কেজির সিলিন্ডারের দাম প্রকৃত দামের চেয়ে ৪ গুণ পর্যন্ত বেশী নেয়া হয়।
এসব অভিযোগের যাচাইয়ে জেলার ৩টি উপজেলার বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বহুতল ভবন ও জুয়েলার্সে গেলে সত্যতা পাওয়া যায়।
নাটোর সদরের মাদ্রাসা মোড়ের ঔষধ ব্যবসায়ী ইব্রাহীম হোসেন অভিযোগ করেন, ‘সাইফুল ও শাহীন নামের ফায়ার সার্ভিসের দুইজন কর্মকর্তা এসে জানায়, ছোট দোকান তাই অগ্নি নির্বাপন লাইসেন্স দরকার নাই, তবে যন্ত্র না নিলে সমস্যা হবে। তখন ২৫০০ টাকা দিলে তারা ৫ লিটারের একটা সিলিন্ডার পাঠিয়ে দেয়। তবে এর প্রকৃত দাম ৮৫০ টাকা, যা জানতাম না।’
ব্যবসায়ী মহসীন আলী জানায়, ‘ফায়ারম্যান সাইফুল ২২০০ টাকা নিয়ে ৫ লিটারের সিলিন্ডার দেয়। প্রকৃত দাম জানার পর অতিরিক্ত টাকা নেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি দেখা করার কথা বলে আর দেখা করেন নি।’
সিংড়া উপজেলার সেবা ক্লিনিকের পরিচালক হারুনুর রশীদ সরাসরি নাটোর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আকতার হোসেন ও ফায়ারম্যান সাইফুলের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেন। তিনি আরো বলেন, গত বছর তারা দুজনে দলবলসহ ক্লিনিকে এসে দুইটি সিলিন্ডারের লাইসেন্স, নবায়ন ও রিফিল চার্জের নামে নগদ ৫ হাজার টাকা নেন। ফেরার সময় রিফিলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের দুইটি সিলিন্ডারও নিয়ে যান। তারপর আর যোগাযোগ করেননি। এখন ফোন করলে সাড়া দেননা।’
নলডাঙ্গা উপজেলার মোল্লা জুয়েলার্সের সত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম মোল্লা জানান, মোবাইল কোর্টের ভয় দেখিয়ে নলডাঙ্গা বাজারের বিভিন্ন দোকানে ২২০০ টাকা দামে এক একটি ৫ কেজির সিলিন্ডার বিক্রি করেছেন ফায়ারম্যান সাইফুল। সিলিন্ডারের প্রকৃত দাম বুঝতে পারছি আমাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে।’ শহরের উত্তরা
সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মকবুল হোসেন জানায়, সমিতির সদ্যপ্রয়াত সভাপতি ৪টি অগ্নি নির্বাপক সিলিন্ডারের জন্য ৬ হাজার টাকা দিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। সেগুলো রিফিলের জন্য ৭০০টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হতো বলে জানতাম।’
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) এর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ভবেশ চন্দ্র চক্রবর্তী জানান, ‘অগ্নি নির্বাপন যন্ত্রের দাম ও রিফিলের ব্যাপারে আমাদের কোন ধারণা ছিলো না। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ শহরের বাইরে স্বর্ণের দোকানগুলোতে গেলে সেখানকার ব্যবসায়ীরা হয়রানি থেকে বাঁচতে দামাদামী না করে যন্ত্রটি কিনতো। ভ্রাম্যমান আদালত ও জরিমানার ভয় দেখাতো বলে অনেক সদস্যের অভিযোগ শুনেছি।’
এ ব্যাপরে আকতার হোসেন ও সাইফুল ইসলামের বক্তব্য নিতে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের নাটোর কার্যালয়ে গেলে তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির অফিস সহকারী জানান, আকতার হোসেন দাপ্তরিক কাজে অন্যত্র আছেন আর সাইফুল ইসলাম ১০ দিনের ট্রেনিংয়ে বাইরে আছেন।
সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে উপ-সহকারী পরিচালক আকতার হোসেন এই অভিযোগকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবী করেন। এর বাইরে তিনি আর কিছু বলতে চাননি।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের রাজশাহী বিভাগীয় উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, ‘অভিযুক্ত আকতার হোসেনের বিরুদ্ধে এর আগেও অভিযোগ এসেছে এবং তদন্ত হয়েছে। বর্তমানে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পুনরায় তদন্ত করা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইননানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খবর ২৪ঘণ্টা/ নই
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পুর্ণ বেআইনি।