নজরুল ইসলাম জুলু: ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম( সিডিএমএস) হলো বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের অন্যতম হাতিয়ার। এটি এমন একটি হাতিয়ার যার মাধ্যমে যে কোন ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে পূর্বে কখনো কোথাও মামলা হয়েছে শুধুমাত্র এ তথ্যের ভিত্তিতে তাকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে পুলিশ যে কোন অপরাধ ও অপরাধীর অপরাধ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংরক্ষন করে রাখে। যে কোন মামলা দায়ের করা হলে সে মামলার আসামী, ধারা, ইত্যাদি এর মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়।
এটি অপরাধ ও অপরাধী সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণের একটি আইনানুগ প্রক্রিয়া। বর্তমানে পুলিশের এই ব্যবস্থাটির যথাযথ ব্যবহার করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। বরং, এটির বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি / ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। সিডিএমএস কে হাতিয়ার করে চলছে ‘সন্ত্রাসী’ বানানোর অপচেষ্টা। যে কোন পেশাজীবী ব্যক্তি, রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সাধারণ মানুষ যাদের বিরুদ্ধে পূর্বে কোন কারণে মামলা দায়ের করা হয়েছে বা বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের সবার তথ্য সযত্নে এখানে সংরক্ষণ করা হয়। আর এই তথ্যই অনেকের কাছে ‘কালসাপ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, শুধুমাত্র, পূর্বে কখনো এক বা একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হয়েছে এই কারণেই এমন অনেক ব্যক্তিদেরকেই পুলিশের খাতায় ‘সন্ত্রাসী’ বানানো হচ্ছে। পুলিশ তার নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সিডিএমএস কে কাজে লাগিয়ে এইসব ব্যক্তিদের ‘সন্ত্রাসী’ তকমা লাগাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো শুধুমাত্র কারও বিরুদ্ধে এক বা একাধিক মামলা থাকলেই কী তাকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করা যায়?
বাংলাদেশে বহু পেশাজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক রোষানলের কারণে বা পারিবারিক দ্বন্দ্বে বা ব্যবসা ক্ষেত্রে গোলযোগের কারণে বা গ্রাম্য রাজনীতির শিকার হয়ে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত হয়েছে। কাউকে সামাজিক ভাবে হেয় করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায়শই মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয় বলেও অভিযোগ উঠে। মামলা মিথ্যা, সত্য, ষড়যন্ত্রমূলক যাই হোক না কেন তার যাবতীয় তথ্য সিডিএমএস এ উল্লেখ থাকে।
ষড়যন্ত্রমূলক, মিথ্যা, ভিত্তিহীন মামলা গুলো থেকে প্রাথমিক অভিযুক্তকারীরা পুলিশের চূড়ান্ত রিপোর্র্ট বা দীর্ঘ আইনী লড়াই এবং সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতির পর আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেলেও সিডিএমএস এ তাদের নামটা অভিযুক্ত অপরাধীর তালিকাতেই থেকে যায়। অর্থাৎ, পুলিশের চূড়ান্ত রিপোর্টে প্রাথমিক ভাবে অভিযুক্তকারী বা অভিযুক্তকারীদের নাম না থাকলেও বা আদালত তাদের নির্দোষ বলে রায় দিলেও তাদের নামটা অপরাধীর তালিকাতেই থেকে যায়।
নির্দোষ হওয়ার পরও অপরাধীর তালিকায় নাম থেকে যাওয়া সত্যিই দুঃখজনক এবং চিন্তার বিষয়। কারণ, পুলিশ প্রাথমিক ভাবে মামলা ও মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সিডিএমএস এ লিপিবদ্ধ করে রাখলেও নতুন তথ্য হালনাগাদ করে না। সে মামলাগুলো বর্তমানে চলমান কিনা, অভিযুক্তদের মধ্যে কে নির্দোষ প্রমানিত হয়েছে, কে দোষি সাব্যস্ত হয়েছে, মামলার রায় কি ইত্যাদি বিষয় গুলো সিডিএমএস এ সংযুক্ত করা হয় না। এমনকি সেগুলো দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা সংযুক্ত করার প্রয়োজনও বোধ করেন না। আর এই দায়িত্ব অবহেলা বা অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে বানানো হচ্ছে ‘সন্ত্রাসী’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন অব্যস্থাপনার জন্য ‘সন্ত্রাসী’র’ সংজ্ঞায় পরিবর্তন হতে বসেছে। বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসী হওয়া বা সাজানো সডিএিমএস এর কল্যানে
খুবই সহজ হয়ে গেছে। কারো বিরুদ্ধে কখনো কোন মামলা দায়ের হয়ে থাকলেই সিডিএমএস অনুযায়ী সে সন্ত্রাসী। কারণ, তার নাম সডিএিমএস এ আছে। মামলায় প্রাথমিক ভাবে অভিযুক্ত/অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস হলেও সিডিএমএস এ নাম থাকলে যে কোন সময় যে কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাকে/তাদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করা যেতে পারে।
পুলিশের বিরুদ্ধে বর্তমানে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে অনেক নিরীহ মানুষকেই মাদক ব্যবসায়ী বা সেবনকারী বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এই সবকিছুর মধ্যে সিডিএমএস আরেকটি আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু তাই নয় এমন কোন ব্যক্তি যে রাজনৈতিক বা পুলিশের আক্রোশের শিকার, যার বিরুদ্ধে পূর্বে মামলা ছিল এবং তাকে নতুন করে আবার পুরোনো মামলায় অজ্ঞাত নামা আসামীদের মধ্যে নাম দিয়ে গ্রেফতার দেখিয়ে কোর্টে চালানের সময় তার পূবের্র যাবতীয়
মামলা ও মামলা সংক্রান্ত তথ্য এবং সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন কিছু বিশেষণ সংযুক্ত করা হয় যা আদালতের চোখে সে ব্যক্তিকে খারাপ করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। পুরোনো মামলার তথ্যাদি সংযোজনের সময় দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা মোটেও খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না মামলা গুলো বর্তমানে চলমান কিনা বা সে ব্যক্তি বেকসুর খালাস কিনা। অনুসন্ধানে জানা গেছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও পুলিশ তার নিজস্ব স্বার্থ পূরণের জন্যই সডিএিমএস এর তথ্য হালনাগাদ করে না। আর একেই তুরূপের তাসের মতো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কিন্তু, প্রশ্ন হলো সিডিএমএস এ কি সব ধরনের অভিযুক্তদের নাম লিপিবদ্ধ করা যায়? না,
সিডিএমএস সব ধরনের অভিযুক্তদের নাম লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য না। সিডিএমএস হলো দুধর্ষ, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, পেশাদার খুনীদের তালিকা লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য।
কিন্তু, শুধুমাত্র স্বার্থান্বেষী মনোভবের কারণে গণহারে সব অভিযুক্তদের নামই সডিএিমএস এ লেখা হচ্ছে।
খবর ২৪ ঘন্টা.কম এ ব্যপারে মোঃ মনিরুজ্জামান (মনির) এডভোকেট অতিরিক্ত পি.পি, জজ কোর্ট, রাজশাহী এর কাছে প্রশ্ন করলে, তিনি বলেন, “সিডিএমএস শুধুমাত্র চিহ্নিত পেশাদারী সন্ত্রাসী, খুনী তাদের জন্য। কিন্তু, বর্তমানে গণহারে সবার ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা মোটেও ঠিক না। আমি পূর্বেও এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মিটিংয়ে বলেছি। প্রয়োজনে আবার বলব। এই অব্যবস্থাপনার পরিবর্তন প্রয়োজন।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “ এটি চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে দ্রুত তথ্য জানার অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু এটাকে যে যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে থানার একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাউকে আইনের দৃষ্টিতে খারাপ করতে পারে।”
শুধু তাই নয় আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে থানা থেকে মিথ্যা মামলা হিসাবে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রদানের পরও সিডিএমএস এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয় নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে তুলে প্রসংশনীয় ভূমিকা পালন করছেন। এই ডিজিটাল বাংলাদেশে বাংলাদেশ পুলিশের এমন ব্যাকডেটেড ব্যবস্থাপনা সত্যিই দুঃখজনক। সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষার জন্য সিডিএমএস এর তথ্য যেন ডিজিটাল উপায়ে সংরক্ষণ এবং নিয়মিত আপডেট করা হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কাউকে যেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে হেয় না করা হয় সে বিষয়ে সরকারকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
পুলিশের কর্মকর্তাদের মনে রাখতে হবে তারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত। তাদের কাজ জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা। তারা যদি নিজেদের ব্যক্তিগত আক্রোশ অথবা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নির্দেশে এমন অব্যস্থাপনা করেন তা সমাজের জন্য মোটেও ভালো হবে না। তারাও জনগণের বিশ্বাস হারাবেন। পুলিশকে তাদের দায়িত্ব রাজনৈতিক চাপ মুক্ত হয়ে পালন করতে হবে।