খবর ২৪ ঘণ্টা ডেস্ক: ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। যা সমাজের মধ্যবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের আয়ের ওপর আঘাত করবে। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তারা।
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বাড়তি কর আরোপ করায় এসব সীমিত আয়ের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা কাজ করছে। ফলে সঞ্চয়পত্রের সুদ তুলতে গ্রাহকরা ভিড় করছেন বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকে।
অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী, প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। এখান থেকে পাওয়া মুনাফায় অনেকের সংসার চলে। এজন্য বিভিন্ন মহলসহ জাতীয় সংসদের চলমান বাজেট অধিবেশনে এ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বর্ধিত উৎসে কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হতে পারে।
তবে আগামী ৩০ জুন বাজেটের সমাপনী অধিবেশনে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর দ্বিগুণের প্রস্তাব পাস হবে কিনা তা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওপর। আর প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বাড়তি কর আরোপ করায় তা উপস্থাপনের পর থেকেই সঞ্চয়পত্র নির্ভরশীল সীমিত আয়ের মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়েছেন।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সঞ্চয়পত্র একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। এটা এক ধরনের সামাজিক সাহায্য। তারপরও সরকারের বাজেটঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ অর্থের অন্যতম উৎস সঞ্চয়পত্র। ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতের সুদের হার তুলনামূলক কম হওয়ায় গ্রাহকদের বরাবরই সঞ্চয়পত্র কেনার ঝোঁক বেশি থাকে। কারণ বয়স্ক নারী, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ মধ্যবিত্তশ্রেণীর অনেকের জীবনযাপনে সহায়ক ভূমিকা রাখে সঞ্চয়পত্র। ফলে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার একটি মাধ্যম সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর বাড়ানো উচিত হয়নি।
অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলেন, উৎসে করের হার বাড়িয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর পক্ষে আমি নই। আমি মনে করি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ‘পেনশনার সঞ্চয়পত্র’ এবং মহিলাদের জন্য ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’ ছাড়া অন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমালে বিক্রির চাপ অনেকটাই কমে আসবে। এজন্য সঞ্চয়পত্রের উৎসে করের হার বাড়ানোর প্রস্তাব নানা মহলে সমালোচিত হয়েছে।
জাতীয় সংসদেও সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর কমানোর দাবি তুলেছেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী। তার মতে, গ্রামের বিধবা অনেক নারী সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল। ‘ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে, গাড়ি কেনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, সেখানে কেন অসহায়দের পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে হাত দিতে হলো’? প্রশ্ন রেখেছেন মতিয়া।
এদিকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বাজেটে প্রস্তাবিত বর্ধিত কর আরোপের প্রস্তাব নিয়ে এরইমধ্যে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় তা প্রত্যাহার করা হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের দু’টি চিন্তা রয়েছে। এর একটি হচ্ছে- বাজারে প্রচলিত সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের ওপর থেকে বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হবে। অথবা শুধু
পরিবারভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ওপর তা প্রত্যাহার করা হবে। তবে সবধরনের সঞ্চয়পত্রের ওপর নাকি শুধু পারিবারিক ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পাসের দিন তথা ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্ধিত কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করতে পারেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থমন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আজ পর্যন্ত আমরা যা জানি তাতে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। কিন্তু সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের ওপর তা প্রত্যাহার করা হবে নাকি, শুধু পারিবারিক ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রত্যাহার করা হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি জানতে হলে অর্থবিল যেদিন পাস করা হবে সেদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে। সেদিন প্রধানমন্ত্রী নিজে তা প্রত্যাহারের জন্য অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে পারেন।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কেটে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে এই কর ছিল মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ থেকে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
প্রতি তিন মাস পর এই সুদ বা মুনাফা বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লাগাম টেনে ধরতে ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল, কিন্তু বিক্রি কমেনি। এরপরও দুই দফা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কমানো হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুনাফা তুলতে গত ১৫ জুন থেকেই সাধারণ মানুষ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। প্রতিনিয়তই ভিড় বাড়ছে। সাধারণ দিনের তুলনায় ৬-৭ গুণ গ্রাহক বেড়েছে। অন্য সময় যেখানে ১০০ টোকেন দেওয়া হয়, এখন সেখানে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টোকেন দিতে হচ্ছে। ৩০ তারিখের আগ পর্যন্ত মুনাফা তোলার এই প্রবণতা কমবে না বলেও মনে করছে তারা।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মুখলেছুর রহমান বলেন, অবসরের সময় পাওয়া টাকা দিয়ে পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা তুলে সংসার চালাই। মুনাফার টাকা তুলতেই ব্যাংকে এসেছি। প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে ১ জুলাইয়ের পর মুনাফা তুললে এতদিন যা পেতাম, তা পাব না। সরকার মধ্যবিত্তের মুনাফার টাকাতেও ভাগ বসাতে চায়। তাহলে আমরা কোথায় যাবো। তাই আগের কয়েক মাসের মুনাফার টাকা এক সঙ্গে তুলতে এসেছি।
সৌদি প্রবাসীর স্ত্রী নাসিমা হক দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে থাকেন যাত্রাবাড়ীতে। স্বামীর পাঠানো টাকা দিয়ে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন বছর কয়েক আগে। মুনাফা তুলে তুলে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখাসহ অন্যান্য খরচ চালাতেন। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে মুনাফা না তুললে ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ হারে কর কাটা হবে শুনে তিনি টাকা তুলতে এসেছেন। এখন কম টাকা পাওয়া গেলে কীভাবে চলবে জানিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
মোহাম্মদপুরের আমিনুল ইসলাম বলেন, পেনশন থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছি। সঞ্চয়পত্রের মুনাফাই এখন তার পরিবারের আয়ের বড় উৎস। সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ কমালো না, কিন্তু আয়ের ওপর কর বাড়ালো। আর নগদ আয় বলতে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা। এই দিয়েই সংসার চলে। শুনেছি ৩০ তারিখের পর থেকে বাড়তি কর কাটবে ব্যাংক। এ কারণে মুনাফার টাকা তুলতে এসেছি। সরকার এখানে কর না বসালেও পারতো।
খবর২৪ঘণ্টা, জেএন