খবর২৪ঘণ্টা.কম: যে কোনো সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আগ্রহের বিষয় থাকে প্রার্থীর নির্বাচনী ইশতেহার। প্রার্থীরাও ইশতেহারে জনগণের ইচ্ছা-প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে চেষ্টা করেন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, নাগরিক সেবার অগ্রাধিকার ভোটারদের চিন্তার খোরাক জোগায়। ওই ইশতেহার হয় ভোটযুদ্ধ জয়ের প্রধান হাতিয়ার। সে অস্ত্র দিন দিন ভোঁতা হয়ে আসছে। আসন্ন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন এমন চিত্রই সামনে এনেছে।
দুপুর থেকে রাত অবধি প্রার্থীর মাইকিং প্রচারণায় ভেসে আসছে প্রতিশ্রুতি। বলা হচ্ছে- কেন ভোটটি তার প্রার্থীর প্রতীকে পড়েবে। অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপি মনোনীত মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল তার মেয়াদে ৩৪ মাস সিটি করপোরেশনের বাইরে থাকার (জেল ও মামলায় আত্মগোপনে) জবাব ভোটারদের ব্যালটে দেখতে চান।
তিনি এখনো নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেননি। তবে তার প্রচারণার ভেতরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ফুটে উঠছে। ইশতেহার ঘোষণায় সবচেয়ে এগিয়ে আওয়ামী লীগ। গণসংহতি আন্দোলন সমর্থিত প্রার্থী মুরাদ মোর্শেদ ও ইসলামী আন্দোলনের শফিকুল ইসলামও ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ভোটযুদ্ধের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী ইশতেহার ঘোষণা না করায় ভোটাররা তুলনা করতে ইশতেহারমুখী হচ্ছেন না। তাতে অবশ্য সমস্যা হচ্ছে না, নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীর পক্ষের নেতাকর্মীরা তির্যক বাক্যবাণ ও প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে একে অপরকে ঘায়েল করছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর উন্নয়ন প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বিএনপি তুলে ধরেছে প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন-নিপীড়নের বার্তা।
প্রতীক বরাদ্দের দিন গত ১০ই জুলাই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। ১১ পৃষ্ঠার ইশতেহারে ১৪টি দফায় ৮১টি প্রতিশ্রুতি ও কর্মপরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয়। কিন্তু নগরবাসীর ওপর চাপিয়ে দেয়া বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে কোনো কথা ছিল না। এই সংক্রান্ত এক প্রশ্নের মুখে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘মেয়র নির্বাচিত হলে আইনি প্রক্রিয়ায় বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্সের বিষয়টি সমাধান করা হবে।’ তার ইশতেহারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা কৌশল। রাজশাহীতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের, ৩৫ হাজার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে এমন চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এলাকা, রিভার ভ্যালি ও ২০-২৫ বছর পর রাজশাহী মহানগরী কেমন হবে- এমন ভিজ্যুয়াল দৃশ্য সংবলিত ডকুমেন্টারি তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘চলো আবারো বদলে দেয় রাজশাহী’ স্লোগানে ভোটারদের কাছে ভোট চাওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ১ লাখ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বারবার বলছেন, যা দলীয় নেতাকর্মীদের নৌকা প্রতীকের পক্ষে জোর প্রচারণা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি ভিশন-২০২১ ও ভিশন-২০৪১ এর মতো রাজশাহীকে নিয়ে ২০৫০ সাল মেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলছেন।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘বর্তমান নগরীর পরিসর ৭৫ বর্গকিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে অন্তত ৩৫০ বর্গকিলোমিটার করতে চাই। পুলিশের নতুন ১২টি থানা এলাকা নিয়ে আমরা সিটি করপোরেশনের নতুন এলাকা ঘোষণা করতে চাই। তাহলে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করা সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা নির্মাণ, বড় বড় রাস্তা, লেক, খেলার মাঠ, দর্শনীয় স্থান, বিনোদনমূলক জায়গা, সাংস্কৃতিক এলাকা, সবকিছু মিলিয়ে একটি চমৎকার শহর গড়ে তুলতে চাই। রাজশাহীকে সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুরের মতো এশিয়ার মধ্যে একটি অন্যতম বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে আমি গড়ে তুলতে চাই।’
এবারের রাসিক নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো ভোটযুদ্ধে নেমেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। প্রথম ২০০৮ সালের সিটি নির্বাচনে তারা ভোটযুদ্ধে নামেন। ওই নির্বাচনে খায়রুজ্জামান লিটন ২৩ দফা নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন। পরে ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে লিটন ৩৭ দফা ইশতেহার প্রকাশ করেন। কিন্তু ওই নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি। ওই নির্বাচনে ২০ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। সে সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব নিয়ে ভোট লড়াইয়ে নামেন বুলবুল।
বিএনপি প্রার্থী সদ্য বিদায়ী মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ‘পাঁচ বছরের মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি মাত্র ২৬ মাস। ৩৪ মাস নগর ভবনের বাইরে রাখা হয়েছিল। এরপরও এই সময়ের মধ্যেই নির্বাচনী ওয়াদার ৮০ শতাংশ পূরণ করেছি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা না থাকলে সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব হতো ইন্শাআল্লাহ।’ তিনি বলেন, ‘এবার ভোটাররা যে ভোটকেন্দ্রে যাবেন সে পরিবেশ নেই। দিনদিন সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে জনগণের রায়কে লুট করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হতে চাচ্ছেন। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া নির্বাচন ও ফলাফল বাংলাদেশ এবং বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। আসলে বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে অরাজকতা ও স্বৈরশাসন চলছে। কাজেই বিএনপি জনগণকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার লড়াইয়ে নেমেছে।
নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা আছে নগরীকে নিয়ে, অল্পসময়ের মেয়াদে তার স্বাক্ষর রেখেছি। নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। গণতন্ত্রহীন পরিবেশে নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত করা যায় না। এই সিটি নির্বাচন নাগরিকদের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার লড়াই। বর্তমানে সরকার দলীয় মেয়র প্রার্থী ধ্বংসের রাজনীতিতে মেতে উঠেছে। নিশ্চিত পরাজয়, আর বিএনপি তথা ২০দলীয় জোটের গণজোয়ার দেখে ভীত হয়ে নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার করছে। নির্বাচনের নামে প্রহসনের খেলা চালাচ্ছে সরকার তথা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। অবৈধ প্রধানমন্ত্রীর অবৈধ উপদেষ্টা এইচটি ইমাম নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন করে রাজশাহীতে বসে নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু রাজশাহীবাসী জানেন রাজশাহীর উন্নয়ন করার জন্য বিএনপির কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের ফ্যাপা বুলির ইশতেহার মানুষ বিশ্বাস করে না। তারা দেখেছে তাদের মেয়রকে কীভাবে পদে পদে সরকার বাধা সৃষ্টি করেছে। এর রায় জনগণ ৩০শে জুলাই নির্বাচনে দেবেন ইন্শাআল্লাহ।’
বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, ইশতেহার না, জনগণ যাতে নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তার পছন্দের প্রার্থীকে রায় দিতে পারেন তা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে বিএনপি ভোটের লড়াইয়ে নেমেছে। জনগণ বিএনপিকে ভালোবাসেন। তাদের রায় ঠেকাতে আওয়ামী লীগ পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করেছে। কিন্তু জেল-জুলুম দিয়ে ধানের শীষ প্রতীকে জনগণের রায় কোনোভাবে আটকে রাখা যাবে না বলে দাবি করছে বিএনপি।
গত ২১শে জুলাই গণসংহতি আন্দোলন সমর্থিত স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মুরাদ মোর্শেদ নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। ‘পরিবর্তন সম্ভব, পরিবর্তন চাই’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ওই ইশতেহারে নগরবাসীর নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, পরিচালনার মূলনীতিতে দুর্নীতিমুক্ত সিটি করপোরেশন, নাগরিকদের অধিকার, প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষা, নগরবাসীর পরিবহন ব্যবস্থা, খাদ্যে ভেজাল ও বিষক্রিয়ারোধ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, শিক্ষার মানোন্নয়ন, বহুবিধ পরিষেবার ওপর নিয়ন্ত্রণ, সংস্কৃতিচর্চা ও বিনোদনের ব্যবস্থা, তরুণ-তরুণীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন, সমগ্র কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতা ও তদারকির আওতায় আনার বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
সর্বশেষে গতকাল বেলা ১১টায় রাজশাহী প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে ৩৩ দফার নির্বাচনী ইশতেহার করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী শফিকুল ইসলাম। এ সময় তিনি রাজশাহী সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানান।
জেলা সুজন সভাপতি ও রাজশাহী প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, নির্বাচনী ইফতেহার, উন্নয়ন প্রতিশ্রুতির চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিশ্চিত করা বেশি দরকার। তাহলেই কেবল টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। কোনো মেয়র ২০৫০ সাল মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান যদি করতে পারেন, তবে কোনো কাজ না করলেও নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। নাগরিকরা নিজ চেষ্টাই নগরীকে ঢেলে সাজাতে পারবেন। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ইশতেহার ঘোষণা করা হয়, তা জনগণের সঙ্গে কথা না বলেই করা হয়। ওই ইশতেহার একটি দলের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটনায়, নাগরিক আশা-আকাঙ্ক্ষার খুব একটা প্রকাশ ঘটে না। তারপরও নির্বাচনী ইশতেহারের গুরুত্ব আছে। এটি দালিলিক প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। মেয়াদ শেষে ওই মেয়র প্রার্থীর কাছে জবাব চাওয়া যায়। মানবজমিন
খবর২৪ঘণ্টা.কম/জেএন
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পুর্ণ বেআইনি।