খবর২৪ ঘণ্টা , স্পোর্টস ডেস্ক: ভিনি, ভিডি, ভিসি। মারাদোনা এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। দুর্গাপুজোর সময় শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের বাহুবলীর মাহেশমতী রাজপ্রসাদে মুগ্ধ জনতা শীতের দুপুরে চাক্ষুষ করলেন ‘ফুটবলের বাহুবলী’ মারাদোনাকে। ৪৫ মিনিটের ঝলমলে উপস্থিতিতে মাতিয়ে দিলেন মারাদোনা তাঁর অগনিত ভক্তকে। ইতিহাস রচনা হল মারাদোনার নিজের হাতে তাঁর মূর্তির আবরণ উন্মোচনে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের মাঝরাতে ফুটবলের রাজপুত্র কলকাতা শহরে প্রথমবার পা দিয়ে হাজার হাজার মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন। আবার এলেন তিনি ৯ বছর বাদে সেই ডিসেম্বরের সন্ধেয়। রবিবার কলকাতা বিমানবন্দরে তাঁকে দেখতে, ছুঁতে ভিড় জমানো জনতার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ভালবাসার চুম্বন। আর এদিন শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের মঞ্চে মারাদোনা হাজির হলেন ডান হাতে ধরা ট্র্যাকসুটের আপারটা মাথার ওপর বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে। লর্ডসের ব্যালকনিতে সৌরভ গাঙ্গুলির ভারতের জার্সি ঘোরানোর ভঙ্গিতে। তখন ঘড়িতে দুপুর ১–৪৫। রাজার মতো মারাদোনার প্রবেশে মুহূর্তে বদলে গেল মাঠের পরিবেশ। ‘দিয়েগো, দিয়েগো’ জয়ধ্বনিতে অভিভূত ফুটবলের ভগবান। মারাদোনার আগমনের প্রতীক্ষায় সকাল ১১টা থেকেই শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের মাঠে জমতে শুরু করেছিল ভিড়। আকাশের মুখ তখনও গোমড়া। ঝিরিঝিরি বর্ষণে অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা শ্রীভূমির কর্ণধার বিধায়ক সুজিত বসুর কপালে হালকা চিন্তার ভাঁজ। অস্থির পায়চারিতে দেখে নিচ্ছিলেন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। ভিআইপি রোডের মুখ থেকে রাস্তা ছেয়ে ছিল মারাদোনার নানা পোস্টারে। অভ্যর্থনা জানাতে তৈরি ছিল সুসজ্জিত তোরণ। শ্রীভূমির প্রাঙ্গণ সেজেছিল মারাদোনার খেলার মুহূর্তের বিভিন্ন ছবিতে। মঞ্চের পিছনে ছাড়াও দু’ধারে লাগানো হয়েছিল বিশেষ স্ক্রিন। মারাদোনার আসার কথা ছিল দুপুর ১টায়। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও মারাদোনাকে দেখতে আসা মানুষের মধ্যে এতটুকু ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি। তাঁদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা অবশ্য রেখেছিলেন সুজিত বসু। জি সারেগামাপা–খ্যাত শিল্পী চন্দ্রিকার গানে গানে কেটে যায় সময়। বল জাগলিং করে হাততালি কুড়োলেন উত্তম দাস। মারাদোনার আসার খবর পৌঁছতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। মারাদোনাকে স্বাগত জানাতে স্প্যানিশ ভাষায় গান ধরেন শিল্পী চার্লস অ্যান্টনি। ফুটবলের রাজপুত্র প্রবেশ করতেই তাঁকে এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানান সুজিত বসু। কপালে পরিয়ে দেওয়া হয় মঙ্গলতিলক। তাঁকে স্বাগত জানানোর এই বিশাল আয়োজন দেখে চমৎকৃত মারাদোনা ও তাঁর বান্ধবী রোশিয়া। মঞ্চে উঠে ট্র্যাকসুটের আপারটা মাথার ওপর ঘোরাতে ঘোরাতেই জনতার দিকে হাত নাড়লেন। বসলেন গিয়ে নিজের আসনে। মেটাচ্ছিলেন বান্ধবীর নানা কৌতূহল। হঠাৎই মারাদোনার চোখ পড়ে গেল মঞ্চের বাঁদিকে অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনি, জানলায় দাঁড়ানো সারি সারি মানুষের দিকে। হাত নাড়লেন তাঁদের উদ্দেশে। ফুলের স্তবক দিয়ে, বিশাল এক মালা দিয়ে মারাদোনা ও তাঁর বান্ধবীকে বরণ করে নিলেন সুজিত বসু। পরালেন উত্তরীয়। উপহার হিসেবে একে একে তুলে দিলেন ফলের ঝুড়ি, মিষ্টির হাঁড়ি, সোনার ব্রেসলেট ও সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের নিজের হাতে আঁকা মারাদোনার ছবি। চিত্রসাংবাদিকরা ছবি তুলতে তুলতে ‘দিয়েগো, দিয়েগো’ চিৎকার করতেই চমকে উঠে ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করলেন মজার মেজাজে। তারপর রীতিমতো কোমর দোলালেন ছবি দিতে। মারাদোনা তো এমনই। মারাদোনার ওপর তথ্যচিত্র স্ক্রিনে ফুটে উঠতেই ফুটবলের দেবতা যেন অন্য জগতের মানুষ। ৮৬–র বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচজনকে কাটিয়ে অবিশ্বাস্য গোল ও বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্তের ছবি দেখে দু’হাত ঝাঁকিয়ে আস্ফালন মারাদোনার। রিমোটের বোতাম টিপে বিশ্বকাপ হাতে নিজের ১২ ফুটের মূর্তির আবরণ উন্মোচন করে বিস্মিত মারাদোনা। সুজিত বসু জানালেন, এই মূর্তি বসানো হবে ভিআইপি রোডের কোনও একটা জায়গায়। অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তটা অবশ্য রীতিমতো আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করে দেয়। মারাদোনার হাত দিয়ে বিধায়ক সুজিত বসু ১০ হাজার টাকা ও ফলের ঝুড়ি তুলে দেন ক্যান্সার আক্রান্ত কয়েকজন মানুষকে। এঁরা হলেন জ্যোৎস্না রায়, মহিমার আলি শেখ, সুসময় চন্দ্র, নৃপেন সরকার, মঞ্জু দত্ত, সুরাবুদ্দিন মণ্ডল, স্বপন বর্মন, রাজদীপ দেবনাথ, অমিত দে, অলকা পাত্র। একই সঙ্গে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সাচ্ছন্দ্যের জন্য গান্ধী সেবাশ্রম সংস্থার কর্ণধারের হাতে একটি গাড়ির চাবি তুলে দেন মারাদোনা। শ্রীভূমিতে উপস্থিত জনতার চোখ ছলছল, যখন মারাদোনা ক্যান্সার আক্রান্ত তরুণের মাথায় বুলিয়ে দিলেন হাত, অন্যদের জড়িয়ে ধরলেন বুকে, ঘাড়ে দিলেন স্নেহের চুম্বন। যাতে ছিল দ্রুত সেরে ওঠার শুভেচ্ছা। বোঝালেন, এমন মানুষদের জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদে। গোটা অনুষ্ঠানে মজে যাওয়া মারাদোনা আবেগ জড়ানো গলায় বলেন, ‘আমি ফুটবলের ভগবান নই। একজন সাধারণ মানুষ। দ্বিতীয়বার কলকাতায় আসতে পেরে খুশি। আপনাদের এই অভ্যর্থনায় অভিভূত। কখনও ভাবিনি কলকাতায় আমার মূর্তি বসবে। দুর্দান্ত ব্যাপার। কোনও দিন ভুলতে পারব না এই দিনটা।’ শ্রীভূমির মাঠ ছেড়ে ধুলাইওয়ালা প্যালেসে পাঁচ মিনিট কাটিয়ে হোটেলে ফেরেন মারাদোনা।