খবর২৪ঘণ্টা.কম: মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের ইয়াবা নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের তৎপরতায় ইতোমধ্যে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেছেন। তবে এখনও আসছে ইয়াবার চালান। বিভিন্ন সময় তা ধরাও পড়ছে। অবস্থার পরিবর্তনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় গত দুই মাসে টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছেন।
সর্বশেষ (১ মার্চ) শুক্রবার ভোরে টেকনাফ উপজেলায় পুলিশ ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদস্যদের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে চার জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং এলাকায় পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরী পাড়ার আব্দুল জলিলের ছেলে নজির আহমদ (৪০) ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নয়াপাড়ার মোহাম্মদ জাকারিয়ার ছেলে গিয়াস উদ্দিন (৩০)। অন্যদিকে সাবরাং এলাকায় বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন সদর ইউনিয়নের ডেইল পাড়ার কালু মিয়ার ছেলে আব্দুল শুক্কুর (৫০) ও তার ছেলে মোহাম্মদ ইলিয়াছ (৩০)।
এসময় তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ইয়াবা ও ৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এরা সবাই শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি করে পুলিশ ও বিজিবি।
আইনশৃঙ্খলা বহিনীর তথ্য মতে, গত বছরের মে মাসে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর শুধু কক্সবাজারে এখন পর্যন্ত ৬১ জন নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে ৫১ জনের বাড়ি টেকনাফ উপজেলায়। তবে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত (দুই মাসে) কক্সবাজার জেলায় বন্দুকযুদ্ধে মোট ২৫ জন নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ২২ জন।
এদিকে চলমান অভিযানে যদি ইয়াবার চালান বন্ধ না হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মাদক বিরোধী অভিযান চালাবে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবি এম মাসুদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী, ফলে কেউ রেহাই পাবেন না। ইয়াবা ব্যবসা ছেড়ে আত্মসমর্পণ করুন, তা না হলে পরিণতি ভালো হবে না এবং ইয়াবা বন্ধ করতে পুলিশ সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করবে।’
র্যাব ও বিজিবির ভাষ্য মতে, কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের সময় গত এক মাসে (ফেব্রুয়ারি) র্যাব-১৫ এর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ৪৬ হাজার পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করে। এছাড়া মাদক কারবারিদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এক জন নিহত হয়। এসব ঘটনায় ২টি অস্ত্রসহ সাত জনকে আটক করা হয়। তার মধ্যে তিন জন রোহিঙ্গা। অন্যদিকে বিজিবির সদস্যরা গেল মাসে ৩ লাখ ৭১ হাজার ২৭৪ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। বিজিবি এসব ঘটনায় ৪১টি মামলা ও আটক করে ২৬ জনকে।
স্থানীয় ও একাধিক সূত্র জানায়, সরকার মাদকের বিষয়ে কঠোর নীতি নেওয়ায় ইয়াবা কারবারিদের তৎপরতা কিছুটা কমেছে। টেকনাফ ঘিরে ইয়াবার রমরমা কারবারও আগের তুলনায় অনেক কমেছে।
দীর্ঘ দিন ‘সেফহোমে’ থাকার পর ১৬ ফেব্রুয়ারি ইয়াবা-অস্ত্র নিয়ে স্বেচ্ছায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের সামনে আত্মসমর্পণ করেন টেকনাফের ১০২ জন ইয়াকারবারি। তখন ধারণা করা হয়েছিল, এই উদ্যোগের পর টেকনাফে মাদক ব্যবসা বন্ধ হবে, নিহতের সংখ্যাও কমবে।
তবে এখন নতুন নতুন রুট ব্যবহার করে সমুদ্রপথে কারবারিরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রপথে পাচারের সময় এক লাখ পিস ইয়াবাসহ মিয়ানমারের ১১ নাগরিককে গ্রেফতার করে কোস্টগার্ড। তাছাড়া টেকনাফে ইয়াবারোধে কড়াকড়ি জারি থাকায় মাদক কারবারিরা রুট পরিবর্তন করছে। এখন মিয়ানমার থেকে সরাসরি সমুদ্রপথে ও অন্যান্য রুটে ইয়াবা বড়ি কক্সবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রাম, পতেঙ্গা, আনোয়ারা, কুমিল্লা, সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যাচ্ছে।
টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের (বিজিবির) অধিনায়ক লে. কর্নেল আছাদুদ-জামান চৌধুরী জানান, ‘মাদক ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ইয়াবা বন্ধে বিজিবি সদস্যরা জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।’
গত দুই মাসের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ১ মার্চ পৃথক বন্দুকযুদ্ধে চারজনের মৃত্যর ঘটনা ছাড়াও ২৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে টেকনাফের খারাং খালি তিন নম্বর স্লুইস গেইট এলাকায় বিজিবির ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বিল্লাল হোসেন (৩৮) নামে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। ২২ ফেব্রুয়ারি ভোরে দমদমিয়ায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন নুরুল আলম (৩০) নামে এক রোহিঙ্গা। তার বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ থাকার কথা বলেছে র্যাব। একই দিন সাবরাংয়ের কাটাবুনিয়ায় বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বেল্লাল হোসেন (২৫) নামে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। এ ছাড়া পাঁচ নম্বর স্লুইস গেট এলাকায় ২০ ফেব্রুয়ারি একইভাবে মারা যান মোহাম্মদ জাফর আলম (২৬) নামে এক রোহিঙ্গা। তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ আনা হয়। মহেশখালীর কালমাদিয়া নামক স্থানে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ‘বন্দুকযুদ্ধে’শাহাব উদ্দীন নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। গত ২৮ জানুয়ারি নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে মাদক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (২০) ও মোহাম্মদ রফিক (৫৫) নিহত হন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এর আগে ২৪ জানুয়ারি টেকনাফে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই জন ইয়াবা ব্যবসায়ী এবং মহেশখালীতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’এক ডাকাত নিহত হন। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী সামছু পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ২১ জানুয়ারি। টেকনাফ পৌরসভার উত্তর জালিয়াপাড়ায় ২০ জানুয়ারি বিজিবি ও পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মোস্তাক আহমদ ওরফে মুছু (৩৫)। এছাড়া ৪ থেকে ১২ জানুয়ারি কক্সবাজারে নিহত হয়েছেন আরও নয় মাদক ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে মাত্র একজন জেলা শহরের এবং বাকি আটজনই টেকনাফ এলাকার।
র্যাব-১৫ এর টেকনাফ ক্যাম্পের ইনচার্জ লে. মির্জা শাহেদ মাহতাব বলেন, ‘আত্মসমর্পণকারীদের বাইরে এখনও অনেক শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়ে গেছে। ফলে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসা কিছুটা কমলেও তা বন্ধ হয়নি। কিন্তু ইয়াবা বন্ধে র্যাবের টহল জোরদার করা হয়েছে।’
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, “এক সময় ইয়াবা প্রবেশের মূল পয়েন্ট ছিল টেকনাফ। এ সূত্রে এ সীমান্তে সক্রিয় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক বেশি। যে কারণে মাদকবিরোধী অভিযানে গেলে মাদক কারবারিরা গুলি ছোড়ে ‘আত্মরক্ষার্থে’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও গুলি ছোঁড়ে। এতে ‘বন্দুকযুদ্ধ’র ঘটনা ঘটছে। এই সীমান্তে ইয়াবা কারবারির সংখ্যা বেশি তাই অভিযানও বেশি হচ্ছে।” সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
খবর২৪ঘণ্টা, জেএন