খবর২৪ঘণ্টা ডেস্ক:
দিনাজপুর বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কেলেঙ্কারির সঙ্গে চার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জড়িত। এরা হলেন সদ্য সাবেক এমডি প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদ, সাবেক এমডি এসএম নরুল আওরঙ্গজেব, আমিনুজ্জামান ও কামরুজ্জামান।
পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনার সঙ্গে এদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত থাকার আভাস দেয়া হয়েছে। বুধবার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
গত শুক্রবার পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বুধবার পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কাছে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করেন। চেয়ারম্যান রিপোর্টটি বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর হাতে তুলে দেন।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই রিপোর্ট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক করেন। বুধবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হয়।
ঘটনাটি অধিকতর তদন্তের জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা থাকবেন। গত ১৩ বছরে কয়লা খনির অনিয়ম, দুর্নীতি তদন্ত করে দেখবে।
তদন্ত রিপোর্টের বিষয়ে জানতে চাইলে বুধবার বিকালে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সাংবাদিকদের বলেন, আমি তদন্ত রিপোর্ট পেয়েছি। এখনও পড়িনি।
তবে যতদূর জেনেছি, এতে খনির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামি ছাড়াও এর আগে ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত এমডিসহ শীর্ষ পদে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই এই চুরির সঙ্গে জড়িত। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অভিযোগে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পেট্রোবাংলার তদন্ত প্রতিবেদনে কী আছে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান কামরুজ্জামান বলেন, আমি যা পেয়েছি আমার চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করেছি।
এর বেশি কিছু বলতে পারছি না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির এক সদস্য জানান, গত ১৩ বছরে এমডি থেকে উপমহাব্যবস্থাপক পর্যন্ত পদে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা এ অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাবেক এমডি আমিনুজ্জামানের সঙ্গে রাতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি ভীষণ ব্যস্ত, এখন কথা বলতে পারব না।
এদিকে কয়লা চুরির ঘটনায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) অপসারণকৃত ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদসহ ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তদন্ত করবে দুুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার মামলার কপি দুদকের দিনাজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক বেনজির আহমেদ পেয়েছেন।
তিনি কপিটি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে মামলা তদন্তের জন্য তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করেন। দুদকের উপ-পরিচালক মো. সামসুল আলমকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার সম্ভাবনা আছে।
তদন্ত শুরু হলেই আসামিদের গ্রেফতারে অভিযানে নামবে দুদক। অন্যদিকে কয়লাচোরদের চাকরিচ্যুতিসহ তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অসাধু কর্মকর্তাদের কমিশন বাণিজ্য বন্ধ, স্থানীয় অভিজ্ঞ শ্রমিকদের নিয়োগ দানে টালবাহানা ও নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধের দাবিতে খনি এলাকায় বুধবার বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল করে।
খনির কয়লা চুরির ঘটনায় সোমবার দুদক থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করেছে। অনুসন্ধান টিম মঙ্গলবার খনির এমডিসহ ৪ কর্মকর্তার বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এ ছাড়া মঙ্গলবার রাতেই বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বাদী হয়ে চুরির ঘটনায় পার্বতীপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলায় সদ্য খনির অপসারণকৃত এমডি হাবিব উদ্দিন আহমেদসহ ১৯ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। পার্বতীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফকরুল ইসলাম জানান, ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ মেট্রিক টন কয়লা খোলাবাজারে বিক্রি করে ২৩০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
দুদকের দিনাজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক বেনজির আহমেদ বুধবার বিকালে বলেন, কয়লা খনি থেকে ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা গায়েবের ঘটনায় করা মামলাটি আমরা পেয়েছি।
এটি তদন্তের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ চেয়ে প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, খনির ঘটনা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব একটি প্রতিবেদনের কপিও আমরা পেয়েছি। তবে তাতে তেমন কিছু নেই। কারা কীভাবে কয়লা সরানোর ঘটনায় জড়িত সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই। তবে দুদক তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এর আগে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা কোথায় গেল তার ‘পূর্ণ তদন্ত’ করতে সোমবার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৯ খনি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড : কয়লা খনির ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা গায়েবের ঘটনায় খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদ ছাড়া আরও যে ১৮ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে তারা হলেন বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের সাময়িক বরখাস্তকৃত মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) আবু তাহের মো. নুর-উজ্জামান চৌধুরী ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর ডিপার্টমেন্ট) একেএম খালেদুল ইসলাম, সদ্য বদলিকৃত কোম্পানি সচিব ও মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল কাশেম প্রধানিয়া, ব্যবস্থাপক (এক্সপ্লোরেশন) মো. মোশাররফ হোসেন সরকার, ব্যবস্থাপক (জেনারেল সার্ভিসেস) মাসুদুর রহমান হাওলাদার, ব্যবস্থাপক (প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট) অশোক কুমার হালদার,
ব্যবস্থাপক (মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) মো. আরিফুর রহমান, ব্যবস্থাপক (ডিজাইন, কন্সট্রাকশন অ্যান্ড মেইনটেন্যন্স) জাহিদুল ইসলাম, উপ-ব্যবস্থাপক (সেইফটি ম্যানেজমেন্ট) মো. একরামুল হক, উপ-ব্যবস্থাপক (কোল হ্যান্ডলিং ম্যানেজমেন্ট) মুহাম্মদ খলিলুর রহমান, উপ-ব্যবস্থাপক (মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) মো. মোর্শেদুজ্জামান, উপ-ব্যবস্থাপক (প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট) মো. হাবিবুর রহমান, উপ-ব্যবস্থাপক (মাইন ডেভেলপমেন্ট) মো. জাহেদুর রহমান, সহকারী ব্যবস্থাপক (ভেন্টিলেশন ম্যানেজমেন্ট) সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণ, ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) সৈয়দ ইমাম হাসান, উপ-মহাব্যবস্থাপক (মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) মো. জোবায়ের আলী, সাবেক মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) মো. আবদুল মান্নান পাটোয়ারী ও মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) গোপাল চন্দ্র সাহা।
পার্বতীপুর থানার ওসি (তদন্ত) মো. ফকরুল ইসলাম জানান, কয়লা ঘাটতি/চুরির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তাৎক্ষণিকভাবে খনির মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) আবু তাহের মো. নুর-উজ্জামান চৌধুরী ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর ডিপার্টমেন্ট) একেএম খালেদুল ইসলাম, সদ্য অপসারণকৃত ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবউদ্দীন আহম্মেদ, সদ্য বদলিকৃত কোম্পানি সচিব ও মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল কাশেম প্রধানিয়ার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
মামলায় মজুদকৃত কয়লার হিসাবের গরমিলের বিষয়টি দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) এবং ৪০৯ ধারা অনুযায়ী এজাহারভুক্ত করে তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়।
এদিকে কয়লা গায়েবের ঘটনায় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহসহ বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল) বোর্ডের ৬ সদস্য বুধবার বড়পুকুরিয়ার খনিতে ঝটিকা সফর করেন।
সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত তারা খনিতে অবস্থান করে আবার ঢাকায় ফিরে যান। তবে তাদের ঝটিকা সফর সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিক্ষোভ মিছিল : কয়লাচোরদের চাকরিচ্যুতিসহ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অসাধু কর্মকর্তাদের কমিশন বাণিজ্য বন্ধ, স্থানীয় অভিজ্ঞ শ্রমিকদের নিয়োগ দানে টালবাহানা ও নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধের দাবিতে খনি এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে।
বুধবার সকাল ১০টায় বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের ব্যানারে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি গেটের সামনে এই বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়। এ সময় বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এসএম নুরুজ্জামান, কয়লা খনি বাজার শাখার সভাপতি হাবিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ, ফুলবাড়ী শাখার সাধারণ সম্পাদক নুর আলম প্রমুখ।
জানা গেছে, একটি ফেস থেকে নতুন ফেসে যন্ত্রপাতি স্থানান্তরের জন্য গত ১৬ জুন থেকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পুনরায় কয়লা উত্তোলন শুরু হবে আগামী আগস্ট মাসের শেষের দিকে। কয়লার অভাবে ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/জেএন
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পুর্ণ বেআইনি।