ওমর ফারুক :
বেপরোয়া অটোরিক্সার কারণে রাজশাহী মহানগরীতে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও যানজট। অটোরিক্সা চালকদের কারণে নগরীর অভ্যন্তরে দুর্ঘটনাই বাড়ছেনা সেই সাথে ফাঁকা নগরীতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানজট। এই অনিয়ন্ত্রিত ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সার কারণে তীব্র যানযটে ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন সাধারণ মানুষ ও পথচারীরা। আর প্রশিক্ষণহীন এসব অটোরিক্সার চালনায় কারণে-অকারণে যেখানে সেখানে দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে পথচারী, মোটরসাইকেল চালক, প্রাইভেট কার, রিক্সা, ভ্যান ও অন্যান্য যানবহনে থাকা মানুষদের।
শুধুমাত্র এদের বেপরোয়া আচরণের কারণেই ব্যস্ত নগরীর বাসিন্দাদের অনাকাঙ্খিত বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অটোরিক্সা চালকরা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করাচ্ছে। আবার কোন যাত্রী তাদের দাঁড়াতে বললেই তারা সামনে বা পেছন থেকে কোন গাড়ী আসছেনা কিনা না দেখেই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায়। আবার সে কোন দিন যাবে তারও কোন ইন্ডিকেটর দেয় না। আর এতেই পথচারীরা ও অন্যান্য গাড়ীর চালক ও যাত্রীরা দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে। পুলিশ মাঝে মধ্যে অটোরিক্সা চালকদের ধরে জরিমানা করলেও তারা পরিবর্তন হচ্ছে না।
প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে এসব অটোরিক্সা চালকরা ট্রাফিক আইনের কোন তোয়াক্কা করে না। নগরীতে গাড়ী চালানোর কোন নিয়ম অনুসরণ না করেই তারা গাড়ী চালায়। নিয়ম-নীতির যেন কোন বালাই নাই এদের। এরা রাস্তাকে নিজের বাড়ির রাস্তা মনে করেই গাড়ী চালাই।
শুধু চালকদের এমন আচরণের কারণে নগরীর যেসব এলাকা আগে ফাঁকা থাকতো সেসব এলাকাতেও যেন এখন যানযট লেগে থাকছে। কিছুক্ষণ পর পরেই লাগছে তীব্র যানযট। আর এটা মোকাবিলা করেত হিমশিম খাচ্ছে রাজশাহী মেট্রাপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
নগরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেক মোড় বা বাজার এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও তারা এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ অটোরিক্সা চালকদের কোন প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা যেখানে সেখানে যাত্রী উঠানামা করায়। আর এ কথা বলতে অনিয়ন্ত্রিত অটোরিক্সা চালকরা ট্রাফিক পুলিশের সাথেই তর্কে জড়িয়ে পড়ে। আর সাধারণ মানুষের কোন কথার তোয়াক্কাই করে না এরা।
নগরীর প্রায় প্রত্যেকটি এলাকায় অটোরিক্সা-অটোরিক্সা মুখোমুখি সংঘর্ষ বা দুর্ঘটনা ঘটে। শুধু নিজেরা নিজেরা দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েনা তারা পথচারী ও মোটরসাইকেল চালকসহ অন্য যানবহন চালকদেরও নিজের খামখেয়ালির কারণে দুর্ঘটনার মধ্যে ফেলে দেয়। এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলছে। কিন্ত কোনভাবেই যেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা। এরা যেন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে।
অনিয়ন্ত্রিত চালকের কারণে যে দুর্ঘটনা ঘটে তাতে করে নিমিষেই ম্লান হয়ে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন। মুহূর্তের মধ্যেই স্বপ্ন পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। আর এজন্য অনেকাংশেই দায়ী অনিয়ন্ত্রিত অটোরিক্সা চালকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্রাফিক আইন না মেনে অটোরিক্সা ও ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালকরা যেখানে সেখানে গাড়ী থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করিয়ে দ্রুত গতিতে চালায়। আর এতেই ঘটে দুর্ঘটনা। বেশিরভাগ অটোরিক্সা চালকরা ট্রাফিক আইন মানেননা। ট্রাফিক আইন না মানার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।
নগরীতে অটোরিক্সা চালকদের বেপরোয়া গাড়ী পার্কিংয়ের কারণে বেশ কিছু এলাকায় যানযট যেন নিত্যসঙ্গী হয়ে পড়েছে। অথচ কিছুদিন আগেও নগরীতে মানুষজন স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারতো।
এসব অটোরিক্সার কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও রাসিকের পক্ষ থেকে কোন অভিযান বা দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়নি।
রাজশাহী মহানগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্ট, গণকপাড়া, সাহেব বাজার মনিচত্বর, রেলগেট, শিরোইল বাস টার্মিনাল, দড়িখরবনা, বর্ণালি মোড়, লক্ষèীপুর মোড়, ভাটপাড়া, কোর্ট শহীদ মিনার, কোর্ট স্টেশন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনডোর ও বহির্বিভাগের গেট, কোর্ট স্টেশন মোড়, কাশিয়াডাঙ্গা, নওদাপাড়া আমচত্বও, তালাইমারী, বিনোদপুর বাজার, বিশ^বিদ্যালয় গেট, খড়খড়ি বাইপাসসহ আরো বিভিন্ন এলাকায় অটোরিক্সা চালকরা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করায়। এতে তীব্র যানযটের সৃষ্টি হয় ও সেই সাথে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে।
আবার মাঝে মধ্যে ট্রাফিক পুলিশের সাথে অটোরিক্সা ও ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালকদের বাকবিতন্ডা করতেও দেখা যায়।
অটোরিক্সা ও ব্যাটারি চালিত রিক্সা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হওয়ায় এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা ট্রাফিক বিভাগ। যার কারণে নগরীতে যানযট কমাতে হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। অটোরিক্সা ও ব্যাটারি চালিত রিক্সা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে নগরীতে যানযট কমবেনা বলেও বিশিষ্ট ব্যক্তিবের্গের অভিমত রয়েছে। যানযট কমাতে গেলে অটোরিক্সা ও ব্যাটারি চালিত রিক্সা নিয়ন্ত্রণ করতে হবেও বলে উল্লেখ করেন তারা।
গত বছর রাসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ব্যাটারি চালিত রিক্সা বন্ধ করে দিয়ে মোটা চাকার রিক্সা রাস্তায় নামানো হবে। কিন্তু রাসিকের কথা যেন কথাই থেকে গেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এটা বন্ধ করার কথা হলেও ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পড়ে গেলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
আবার স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে, অটোরিক্সার নতুন কোন লাইসেন্স না দেওয়ার কথা থাকলেও রাস্তায় নতুন নতুন অটোরিক্সা দেখা যাচ্ছে। রাজস্ব বিভাগের কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে এসব নতুন অটোরিক্সার নম্বর পাওয়া সম্ভব বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কয়েকজন পথচারীর সাথে কথা হলে আব্দুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি বলেন, অটোরিক্সা ও ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালকরা রাস্তার সামনে পেছনে না দেখেই দ্রুত গতিতে চালিয়ে চলে যায়। যাত্রীরা যেখানে তাদের থামতে বলে সেখানেই তারা দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করায়। আবার নেওয়ার জন্য রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িড়ে পড়ে। যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে ও যানযটের সৃষ্টি হয়।
আরেক বাসিন্দা বলেন, এদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করা হলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তাই প্রশিক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ দুটোই করলে নগরীতে দুর্ঘটনা কমে আসতে পারে।
মাসুম নামের আরেক মোটরসাইকেল চালক অভিযোগ করে বলেন, একটা অটোরিক্সা কোন দিকে যাবে তার ইন্ডিকেটর না দিয়েই হঠাৎ করেই ঘুরে যায়। আর এ কারণে তার দুর্ঘটনা ঘটে। তাই তিনি এদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবি করেছেন।
তবে নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, অটোরিক্সা চালকদের মধ্যেই বেশির ভাগই মাদকাসক্ত। যার কারণে তারা নিয়ম নীতি কোন কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। তাই এদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক সার্জেন্ট বলেন, রাজশাহী মহানগরীতে অটোরিক্সায় এতটাই বেপরোয়া ও অনিয়ন্ত্রিত যে আমাকেও ধাক্কা দিয়েছে। ডিউটি পালন করার সময় সাইড থেকে ও পেছন থেকে এসে কয়েক বার মেরে দিয়েছে।
তাদের ধরলে আবার তদবিরও করা হয়। তাহলে অটোরিক্সা কিভাবে নিয়ন্ত্রন করা যাবে বলেন? সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া অটোরিক্সা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে বলে তিনি মনে করেন।
এর আগে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন থেকে জানানো হয়েছিল নগরীতে ৮ হাজার লাইসেন্স প্রাপ্ত অটোরিক্সা চলাচল করছে। তবে অন্যসূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নগরীতে ১০ হাজারেরও বেশি অটোরিক্সা চলাচল করছে। ব্যাটারি চালিত রিক্সার হিসেব পাওয়া যায়নি। এটা অটোরিক্সার থেকে সংখ্যায় খুব বেশি কম হবেনা বলেও জানা গেছে।
এ বিষয়ে নগর পুলিশের মুখপাত্র ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (সদর ও ট্রাফিক বিভাগ) ইফতে খায়ের আলম বলেন, অটোরিক্সা ও ব্যাটারি চালিত রিক্সাদের ধরে মামলা দেওয়া হয়। সিটি কর্পোরেশন এটাকে বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু এখন কি অবস্থা তা ও জানা নেই। ট্রাফিক পুলিশ দিয়েই অটোরিক্সা ও ব্যাটারি চালিত রিক্সা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হবে। তাদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে যাতে তারা সচেতনতার সাথে অটোরিক্সা চালায়।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার হেমায়েত উল্লাহ বলেন, অটোরিক্সার দৌরাত্ম কমাতে ও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে কাজ করা হচ্ছে। দুর্ঘটনা ও যানজট কমাতে চালকদের নিয়ে আরএমপির পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়াও মাঝেমধ্যেও অটোরিক্সা ধরে মামলা দেওয়া হয়।
খবর২৪ঘণ্টা/এমকে