খবর২৪ঘণ্টা ডেস্ক: কম ভোটারের উপস্থিতির মধ্যে শেষ হলো বহু প্রতীক্ষিত ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। দুটি সিটি করপোরেশনই নিজেদের হাতে রাখতে পেরেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম। আর ঢাকা দক্ষিণে নতুন মেয়র হয়েছেন নৌকার মার্কার প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
নির্বাচন কমিশনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক হাজার ৩১৮টি কেন্দ্রের ফলাফলে আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম পেয়েছেন চার লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির তাবিথ আউয়াল ধানের শীষে পেয়েছেন দুই লাখ ৬৪ হাজার ১৬১ ভোট।
অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এক হাজার ১৫০ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের
ব্যারিস্টার তাপস পেয়েছেন চার লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন ধানের শীষে পেয়েছেন দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫১২ ভোট।
ভোটের বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার মধ্যেই জয়ের আভাস পেয়ে নৌকা দুই মেয়র প্রার্থী ফুল ও মিষ্টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে দেখা করেছেন।
অপরদিকে ভোটের ফলাফল আসার কিছু পরেই ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি আজ রোববার ঢাকা শহরে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে হরতালের ঘোষণা দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, তাঁর দল এই হরতাল প্রতিহত করবে।
আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনে বলেছে, এই ফলাফল জনগণ গ্রহণ করবে না।
এই প্রথমবারের মতো ঢাকার দুই সিটিতে দুই হাজার ৪৬৮ কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেলে ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ করা হয়। ভোট গ্রহণ শেষে গণনা শুরু হয়। এরপর ফলাফল আসতে থাকে দুই সিটির ফলাফল বিতরণের জন্য তৈরি করা অস্থায়ী কার্যালয়ে।
ঢাকা উত্তরের বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করা হয় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে আর ঢাকা দক্ষিণের ফলাফল ঘোষণা করা হয় সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তন থেকে।
ভোট চলাকালে প্রকাশ্যে বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটেনি বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন। তবে সন্ধ্যার পরে রাজধানীর নয়াপল্টনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা না হলেও সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
ইভিএম বিড়ম্বনা
প্রথমবারের মতো ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আঙ্গুলের ছাপ না মেলা, পরে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভোট দেওয়া, ভোটের সময় ইভিএম মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো কিছু ঘটনা ঘটেছে। আর এ কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা নিজেও আইডি কার্ড দেখিয়ে ভোট দিয়েছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরামের প্রধান ড. কামাল হোসেনকে বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করে ভোট দিতে হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ অনেক কেন্দ্রেই ভোটাররা করেছেন।
তবে ইভিএম নিয়ে অভিযোগের পাশাপাশি বিএনপি আরো বলেছে, তাদের বেশকিছু এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আবার কোনো কোনো কেন্দ্রে এজেন্টদের যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে।
ইভিএম প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘ইভিএম নিয়ে বিতর্ক এমন জায়গায় এসেছে যে, জনগণ ভোটও দিতে যাচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে, ইভিএম মানুষের মনে এমন একটা প্রশ্ন রেখেছে যে, আজকে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, মানুষ ভোট দিতেও যাচ্ছে না। কারণ পুরো নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা সৃষ্টি করার জন্য ইভিএমের অনেক বড় ভূমিকা। এবং সেটা আজ প্রমাণিতও হয়েছে।’ তিনি এটাও অভিযোগ করেছেন, ‘আঙ্গুলের ছাপ নেওয়ার পর ভোটারকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগ ভুল-ক্রুটির কথা স্বীকার করে বলেছে, ইভিএম সহজ পদ্ধতি। এতে
কারচুপির কোনো সুযোগ নেই।
প্রায় একই কথা বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাও। তিনি বলেছেন, ‘এটা যে খারাপ কেউ সে কথা বলেননি। বলেছে একটু জটিল, দেরি হয়েছে এবং বেশির ভাগ লোক বলেছে যে, ইভিএমে ভোট দিয়ে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। এতে সঠিকভাবে ভোট দেওয়া সম্ভব হয়।’
ভোটারের উপস্থিতি কম
তবে এসব আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই ঢাকার দুই সিটি ভোটে সবচেয়ে বড় জায়গা করে নিয়েছে, কম ভোটারের উপস্থিতি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এক লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভোটারের উপস্থিতি ২৫ শতাংশের মতো হতে পারে। তার কিছু পরেই সিইসি গণমাধ্যমে বলেছেন, উপস্থিত ভোটার ৩০ শতাংশের বেশি হবে না।
প্রায় দেড় কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরের দুই সিটিতে ভোটার প্রায় ৫৫ লাখ। অনেকের ধারণা, ব্যাপক সংখ্যাক কাউন্সিলর প্রার্থীরাই মূলত বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। তাদের ব্যাপক তৎপরতা না থাকলে ভোটারের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কম হতে পারতো।
ভোট প্রত্যাখ্যান, রোববার হরতাল
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। কারচুপির প্রতিবাদে আজ রোববার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীতে হরতাল ডেকেছে দলটি। গতকাল শনিবার রাত ৮টার দিকে রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই হরতালের ডাক দেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এই নির্বাচনকে সম্পূর্ণভাবে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি, ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করছি। এই ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন উত্তর ও দক্ষিণের এই ভয়াবহ রকমের কারচুপি, জালিয়াতি এবং জবরদস্তি করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে এবং জনগণের রায়কে পদদলিত করে একেবারেই একটি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রভাবিত করে এর প্রতিবাদে আমরা আগামীকাল (আজ) সকাল ৬টা থেকে অর্থাৎ সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতাল আহ্বান করছি।’
মির্জা ফখরুল জানান, সকাল থেকেই বিএনপি নেতারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। বিএনপি এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, ভোটারদের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে বুথ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। জোর করে নৌকায় ভোট দেওয়া হয়েছে।
ফলাফল জনগণ গ্রহণ করবে না : সিপিবি
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম শনিবার রাতে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ঢাকা সিটিতে জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এই নির্বাচনের প্রকাশিতব্য ফলাফল জনগণ গ্রহণ করবে না।’
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে দেওয়া প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বামপন্থী দলটি আরো বলেছে, ‘ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল জনগণের মধ্যে নানাভাবে ভয়-ভীতি সঞ্চার করায় অধিকাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট প্রদান করতে পারেনি। নগরীতে ভোটের নামে আরেকবার নতুন ধরনের প্রহসন সংঘটিত হতে দেখল ঢাকাবাসী।’
সাংবাদিককে মারধর
ঢাকা সিটি নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন আহত হয়েছেন। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শনিবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে ধানমণ্ডির রায়েরবাজার সাদেক খান রোডের জাফরাবাদ এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে।
অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘পরিবর্তন’-এর সাংবাদিক সালাউদ্দিন জসিম জানান, ‘সকালে সাদেক খান রোডের একটি ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এ খবর পাওয়ার পরই সুমনসহ আরো অনেক সাংবাদিক সেখানে ছুটে যান। তখন জাফরাবাদ এলাকার রাস্তায় ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন খোকনের সমর্থকরা ২০-৩০ জনের একটি দল শোডাউন করছিল।
মোবাইল ফোনে তার ছবি তুলছিলেন সুমন। পরে একদল এসে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে সুমনের মাথায় পেছন থেকে আঘাত করে। তিনি পড়ে গেলে তাঁকে কিলঘুষি, লাথি, লাঠিপেটা করতে থাকে। সহকর্মীরা এগিয়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। পরে তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ১২টার দিকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।’
এমকে
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পুর্ণ বেআইনি।