মোঃ রাশেদুল ইসলাম, নাটোর প্রতিনিধি :
শরীরে প্যাঁচানো দড়ি, কোমরের ডান পাশে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি। তার ভেতরে রেখেছেন বাটাল, হাঁসুয়া। বাঁ পাশে ঝুলছে মাটির হাঁড়ি। এসব নিয়েই তরতর করে বেয়ে উঠছেন খেজুর গাছে। কৌশলে খেজুরগাছে বাকল তুলে বেঁধে দেন হাঁড়ি। মধ্যরাত থেকে শুরু হয় খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ। রস সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে এসে টিনে জাল দেওয়া শুরু হয় খেজুর রস। টিনের তফালে ঢেলে আগুনে জাল দিতে থাকলে টকবগিয়ে ফুটতে থাকে, এক সময় জাল দিতে দিতে রস কমে লাল হয়ে যায় তখন গুড় তৈরি হয়। এই গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন বাজারে।
নাটোরের ৭টি উপজেলাতে পথের দুই ধারে সারি সারি খেজুর গাছ চোখে পড়ে। শীত মৌসুমের চার মাস এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে সকাল–সন্ধ্যায় বিক্রি হয়। প্রতিদিনই ভোর থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত আহমদপুর বাসস্ট্যান্ডে ও বড়াইগ্রাম রস খেতে শহরের মানুষ সেখানে জড়ো হয়। এবং প্রত্যেকটা বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয় শীতের পিঠা উৎসবের ধুম ।
লালপুরের রহিম উদ্দিন গাছী জানন, প্রতিদিন সকাল ১১ টা থেকে শুরু করে সন্ধা পর্যন্ত ৯০টি গাছ কেটে হাঁড়ি ঝুলিয়ে দেন। এই গাছ কাটা প্রায় প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জন গাছী, সংগে হাড়িতে চুন দেওয়ার কাজে সাহায্য করে বাড়ির অন্যন্যে সদস্য ও সহকারী গাছী। কিছু কিছু গাছ এতোটাই বড় যে রাতে গাছে চড়ে রস নামানো সমস্য হয। সেই তারণে সুতা দিয়ে গাছের এক মানুষ উপড়ে হাড়ি বাঁধা থাকে সেখানে সুত বেঁধে দেওয়া হয়। সারা রাত রস পড়তে থাকে। মধ্যরাত থেকে গাছীরা রস সংগ্রহ শুরু করেন। এভাবে চলতে থাকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত।
এরপর সেখানে ভির করে ছোট বড় সব বয়সের নারী পুরুষ সহ বাচ্চারা কাঁচা রস পান করার জন্য। । মিষ্টি রস মানুষদের কাছে বিক্রি করেন। এই রস ৫ টাকা থেকে ১০ টাকায় গ্লাস।৷ এ রস কেজি হিসাবেও বিক্রয় করা হয়।তবর বেশির ভাগ রস গুড় তৈরির জন্য প্রস্তুত করেন।
সকাল দশটা পর্যন্ত রস থেকে গুড় তৈরি করে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন বাজারে অথবা বাড়ি থেকে । বাগাতিপাড়া গাছী রায়হান জানান ‘বর্তমানে যে হারে খেজুরগাছ কমে যাচ্ছে, হয়তোবা এক সময় এলাকা থেকে খেজুরগাছ হারিয়ে যাবে। তাই বেশি করে খেজুরগাছ লাগানো দরকার বলে মনে করেন।
লালপুর উপজেলা দারপাড়া এলাকার আনসার আলী জানান, প্রতি বছরের মত এ বছর ৪০ টি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। গাছ থেকে ৫ মাস রস সংগ্রহ করে তবে এর মধ্যে মাঝে মাঝে গাছ পালি দেন এতে প্রায় ৩ থেকে ৪ মাস রস সংগ্রহ করে। গড়ে ২ মন পর্যন্ত গুড় সংগ্রহ করেন তিনি।
কার্ত্তিক মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। এ অঞ্চলে খেজুরের রস থেকে তৈরী গুড়ও বেশ প্রসিদ্ধ। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ করা হয় দেশের বিভন্ন প্রান্তে। এছাড়া মুড়ির সাথে খেজুর রস রসনা বিলাসীদের তৃপ্তি মেটানো সহ পিঠা-পুলি তৈরীতে ব্যবহৃত হয় সুস্বাদু এই খেজুরের গুড়। নাটোরের তৈরী খেজুর গুড় গুনে ও মানে ভাল হওয়ায় এখানকার গুড় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চলে যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রতি কেজি গুড় তারা ক্রয় করছেন প্রকারভেদে ৭০ থেকে ৮৫ টাকা দরে। বিক্রি করছেন ৮৫ থেকে একশ টাকা দরে। বর্তমানে একটু শীতের প্রভাব পড়ায় বাজারে গুড়ের আমদানী বেশী হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক সুব্রত সরকার জানান, জেলার প্রায় ৮ লাখ খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। শীতের শুরুতে এই খেজুর গুড়ের বাজার মূল্য বেশ ভালো। খেজুর রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরী করে এখানকার কৃষকরা লাভবান হন। চলতি বছর প্রায় ৮১ কোটি টাকার গুড় বেঁচাকেনা হবে।
এদিকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য আজ হুমকির মুখে। এক কেজি খেজুরের গুড়ের মূল্য ৭০ থেকে ৮০ টাকা আর চিনির মূল্য ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এই জন্য চিনি মিশায় গুড় তৈরি করে গাছিরা লাভবান হলেও ক্রেতারা পড়ছে ভেজালের খপ্পরে।
দেশের চিরাচরিত ঐতিহ্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছেন প্রকৃত গাছিরা ও ভোক্তারা।
আর/এস