পাবনা প্রতিনিধি: দীর্ঘ চার বছর পর বৃহস্পতিবার (২৮ জুন) পাবনার চাটমোহর উপজেলার সবচেয়ে আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা শিশু আব্দুল্লাহ্ আল নুর (৪) হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। রাজশাহীস্থ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারক এই রায় ঘোষণা করবেন।
ওই সময়ের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাটমোহর থানার তৎকালীন এসআই (বর্তমানে পাবনা থেকে ডেপুটেশনে ল ইনস্ট্রাকটর হিসেবে পুলিশ একাডেমি, সারদায় কর্মরত) মো: মঈনুদ্দিন এই তথ্য নিশ্চিত করে জানান, আমি চাটমোহর থানায় দায়িত্ব পালনের সময় মামলার তদন্ত ও চার্জশিট প্রদান করেছিলাম। মুল হোতা সোহেল বিশ্বাসকে প্রধান অভিযুক্ত করে মোট ৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিলাম। বৃহস্পতিবার মামলার রায় হবে বলে আমি জানতে পেরেছি। আমি আশা করি, আসামীর সর্বোচ্চ সাজা হবে।
উল্লেখ্য, চাটমোহর পৌরসদরের হারান মোড় মহল্লার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো: আবুল হোসেনের ৪ বছরের শিশু সন্তান আব্দুল্লাহ্ আল নুর ২০১৪ সালের ২৫ জুন বুধবার সকাল ১১টার দিকে নিখোঁজ হয়। অনেক খোঁজাখুজি করেও নুরের সন্ধান না পেয়ে স্বজনরা পুলিশ সহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা কামনা করেন। পাশাপাশি শিশুটির সন্ধান চেয়ে এলাকায় মাইকিংও করা হয়। এ ঘটনায় শিশুটির পিতা আবুল হোসেন বাদী হয়ে একইদিন রাতে তার বাড়ির ভাড়াটিয়া সোহেল বিশ্বাসকে প্রধান অভিযুক্ত করে সোহেল বিশ্বাসের স্ত্রীসহ অন্তত: ৬ জনকে বিবাদী করে চাটমোহর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
নিখোঁজের দু’দিন পর একই বছরের ২৭ জুন শুক্রবার বিকেলে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে উপজেলার ভাদড়া খেলার মাঠের দক্ষিণ পাশে জলমগ্ন আবাদি জমি থেকে মাথা, হাত, নাড়িভূড়ি বিহীন ক্ষত-বিক্ষত পঁচা দূর্গন্ধযুক্ত বিকৃত একটি শিশুর মৃতদেহ পলিথিন ব্যাগে বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। একই স্থান থেকে অপর একটি পলিথিন ব্যাগ থেকে উদ্ধার হয় শিশুটির শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা দু’টি হাত। খবর পেয়ে শিশুর পিতা আবুল হোসেন মৃতদেহটি তার সন্তান আব্দুল্লাহ্ আল নুরের মর্মে সনাক্ত করেন। ওই সময় সেখানে উপস্থিত শত শত নারী-পুরুষ নর-পশু জল্লাদরূপী হত্যাকারীর পৈশাচিকতায় স্তব্ধ হয়ে যান। সেদিন পুলিশ-সাংবাদিকসহ উপস্থিত কেউই চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। পুলিশ ওইদিনই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে আবুল হোসেনের বাড়ির নীচতলার ভাড়াটিয়া সোহেল বিশ্বাস (৩৮) কে আটক করে।
এ ঘটনার পরেরদিন ২৮ জুন শনিবার বিকেলে আবুল হোসেনের বাড়ির অদুরে হারান মোড় ব্রীজের পাশ থেকে উদ্ধার হয় শিশুটির খন্ডিত মাথা। এদিন পুলিশ কর্মকর্তারা ভাড়াটিয়া সোহেলের ঘর ও ঘরের আশপাশে তল্লাশী চালিয়ে হত্যাকান্ডের সাথে সম্পর্কযুক্ত বেশকিছু আলামত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাটমোহর থানার তৎকালীন এসআই মঈনুদ্দিন তদন্ত শেষে একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। গ্রেপ্তারকৃত প্রধান আসামী সোহেল বিশ্বাস আদালতের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দিও প্রদান করেন। জবানবন্দিতে সে হত্যার সাথে নিজেকে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
এদিকে নিষ্পাপ শিশু আব্দুল্লাহ্ আল নুরের লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা এবং প্রকৃত অপরাধীদের কঠোর শাস্তি’র দাবীতে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন চাটমোহর উপজেলা শাখার উদ্যোগে ৪ জুলাই শুক্রবার চাটমোহর থানা মোড় আমতলায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। চাটমোহরের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এই মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের হাজার হাজার নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ ও সংহতি প্রকাশ করেন।
মামলাটি পাবনা নারী ও শিশু বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বেশকিছু দিন পরিচালনার পর বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করেন। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারক দীর্ঘ স্বাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ শেষে ঘটনার প্রায় ৪ বছর পর আজ বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেছেন। অপরদিকে এই মামলার অপর বিবাদীগণ বিভিন্ন সময়ে জামিন লাভ করলেও বিজ্ঞ আদালত প্রধান অভিযুক্ত সোহেল বিশ্বাসকে অদ্যাবধি কারাগারে আটক রেখেছেন। প্রধান আসামী সোহেল বিশ্বাস ভাঙ্গুড়া উপজেলার অষ্টমনিশা ইউনিয়নের সাহানগর গ্রামের (বর্তমানে চাটমোহর পৌর সদরের চৌধুরীপাড়া মহল্লায় বসবাসরত) পল্লী চিকিৎসক নজরুল ইসলামের বড় ছেলে।
বৃহস্পতিবার মামলার রায় ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন চাটমোহর উপজেলা শাখার সভাপতি সাংবাদিক কে. এম. বেলাল হোসেন স্বপন বলেন, “বিকৃত রুচির খুনি বা খুনিরা একটি নিষ্পাপ শিশুকে যে প্রক্রিয়ায় জঘন্যভাবে হত্যা করেছে, তা সত্যিই লোকহর্ষক একটি বিষয়। আশা রাখি বিজ্ঞ আদালত হত্যাকান্ডের প্রতিটি নির্মমতার প্রতি দৃষ্টি রেখে অপরাধিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির রায় ঘোষণা করবেন।”
মামলার বাদী নিহত শিশু নুরের পিতা আবুল হোসেন ও মা আতিয়ারা পারভীন বলেন, বাবা হয়ে চোখের সামনে নিজের সন্তানের হাত-মাথা খন্ডিত ক্ষত বিক্ষত মরদেহ দেখতে হয়েছে। এর চেয়ে কষ্ট-যন্ত্রণার কিছু নেই। সন্তানকে হারানোর যন্ত্রণা আমাদের ঘুমাতে দেয় না। আমরা চাই, যে বা যারা আমাদের সন্তানকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে তাদের ফাঁসির রায় হোক।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ