বাগমারা প্রতিনিধিঃ বাগমারার নরদাশ ইউনিয়নের জোকা বিলে মৎস চাষ নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে হত্যাকান্ডের রেস কাটতে না কাটতেই দ্বিপপুর ইউনিয়নের লিকরা বিলে মাছ চাষ নিয়ে শোষক সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে বিল এলাকার নিরীহ বঞ্চিত জনগন। লিকরা বিলে তাদের জমির মালিকানা থাকা সত্বেও তারা মাছ চাষের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এতে করে এলাকাবাসী আবারো বড় ধরনের সহিংসতা ও রক্তক্ষয়ী ঘটনা আশঙ্কা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিকরা বিল এলাকার পাঁচ গ্রামের জনগন সম্প্রতি বিল এলাকায় সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ব বন্ধ করে বিলের প্রকৃত মালিকদের বিলের নিয়ন্ত্রন ও মাছ চাষের ন্যায্য হিস্যা বুঝে দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিক আবেদন করলেও অদ্যাবদি কোন সুরাহা না হওয়ায় বিল এলাকার প্রায় চার শতাধিক জমির মালিকদের মাঝে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিল দখলকারী সিন্ডিকেট চক্রের লোকজন গত সোমবার বিল এলাকার প্রকৃত জমির মালিকদের বিরুদ্ধে ছিনতাই ও চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করলে বাগমারা থানার পুলিশ ওই দিন রাতেই বিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুইজনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরন করলে বিল এলাকার ৫ গ্রামে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তাদের দাবী পুলিশ লিকরা বিল নিয়ে জোরজবর দখলকারী সিন্ডিকেট চক্রের পক্ষ নিয়ে নিরীহ লোকজনের বিরুদ্ধে ছিনতাই ও চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা নিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করায় এলাকার সাধারন জনগনের মাঝে গ্রেফতার আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে গ্রেফতারের ভয়ে এলাকার বহিরে গিয়ে অবস্থান শুরু করেছেন।
গতকাল মঙ্গলবার লিকরা বিল এলাকার ২/৩ টি গ্রাম ঘুরে এলাকার ভুক্তভোগি লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, লিকরা বিলের দখল সিন্ডিকেট চক্রের শোষণ কাহিনী।
তারা জানান, সম্প্রতি উপজেলার নরদাশ ইউনিয়নের জোকা বিলে যে ভাবে শোষণের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল ওই এলাকার শত শত জনগন। লিকরা বিলেও তেমন শোষণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠতে শুরু করেছে বঞ্চিত জনগন। তাদের মতে, ২২ হাজার বিঘা আয়তনের জোকা বিলে মাছ চাষে প্রথমে প্রায় নয়শ জনকে নিয়ে বিল সমিতি গঠন করা হলেও পরে একের পর এক সমিতি সদস্যদের বাদ দিতে দিতে পঞ্চাশ জনে নামিয়ে আনা হয়। সেখানে মাত্র ২০/২৫ জন মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করে গোটা বিলের নিয়ন্ত্রন নিয়ে ব্যাপক লুটপাট শুরু করলে বিল এলাকার জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ এপ্রিল হাটমাধনাগর বাজারে ওই হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়। ভুক্তভোগিদের মতে, সম্প্রতি লিকরা বিল নিয়ে শোষন ও লুটপাটের ধারাবাহিকতায় ফুঁসে ওটতে শুরু করেছে এলাকার বঞ্চিত জনগন।
বিলের প্রকৃত জোয়ারদার চকহরি নারায়নকুন্ডু গ্রামের আকবর আলী মৃধা, নজরুল ইসলাম, হাসানপুর গ্রামের সাদেক আলী, আনিছুর রহমান, খলিল শাহ, নানসোর গ্রামের আব্দুর রহিম ও ইয়াকুব আলী সহ ৩/৪ আরো কয়েকটি গ্রামের ৩০/৩৫ জন জোয়ারদাররা জানান, দ্বিপপুর ইউনিয়নের নানসোর, হাসানপুর, চকহরিনারায়নকান্ডু, খাঁপুর ও লাউবাড়িয়া প্রায় চারশতাধিক জনগনের মালিকারা রয়েছে লিকরা বিলে। বিলের আয়তন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিঘা। প্রতি বছর এই বিল থেকে মাছ চাষে প্রায় আড়াই কোটি টাকার বেশি আয় আসে। তারা জানান, ২০০৭ সাল থেকে বিলটি ১০ বছরের জন্য লিকরা বিল মৎস চাষ প্রকল্পের নামে লীজ নেওয়া হয়। ২০১৭ সালে যার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরে বিলের নিয়ন্ত্রকরা বিলের প্রকৃত জোয়ারদার যাদের ওই বিলে বেশির ভাগ জমির মালিকানা রয়েছে তাদেরকে সম্পূর্নরুপে বাদ দিয়ে যাদের বিলে জমির পরিমান অতি সামান্য এমনকি জমির কোন মালিকানাও নেই এমন কিছু লোকদের ভুয়া স্বাক্ষর নিয়ে প্রচার চালাতে থাকে তারা আবারও বিলটি দশ বছরের জন্য লীজ নিয়েছে। প্রকৃত ঘটনা আমরা তাদের এমন কোন লীজ দেইনি। খাঁপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মুক্তিযোদ্ধা ওসমান আলী ও একই গ্রামের কৃষক আমজাদ আলী সহ ১০/১২ জন জানান, ২০১৭ সালে বিলের লীজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে লীজ দেওয়া হয়নি।
বিল দখলকারী সিন্ডিকেট চক্রের হোতা বিলের সভাপতি দাবীদার দ্বিপপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোকলেছুর রহমান দুলাল, কোষাধ্যক্ষা দাবীদার বর্তমান ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিন সরদার, সাবেক চেয়ারম্যান বিকাশ চন্দ্র ভৌমিক, সহ ইউপি সদস্য আফছার আলী, সাবেক ইউপি সদস্য দুলাল হোসেন ও ওয়াজ আলী সহ ২৮ জন মিলে বিল দখল ও মাছ চাষের প্রায় আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে। তারা এই সিন্ডকেটের মাধ্যমে বিলে যাদের কোন জমির মালিকানা নেই অথবা যৎসামান্য জমি রয়েছে এমন দালাল চক্রকে হাত করে এবং তাদেরকে নামমাত্র দালালী দিয়ে বিল লীজের নামে স্বাক্ষর নিয়েছে। অনেককে কোন টাকা পয়সা না দিয়ে জোরপূর্বকও তারা স্বাক্ষর নিয়েছে। তাদের অভিয়োগ বিলে যাদের মোটা দাগে বেশি পরিমান জমি রয়েছে তাদেকে লীজ নেওয়ার ব্যাপারে কোন কিছুই জানানো হয়নি তাদেরকে কোন কোন টাকা পয়সাও দেওয়া হয়নি। তাদের অভিযোগ বর্তমান চেয়ারম্যান ও তার অনুগত ইউপি সদস্য জনপ্রতিনিধি হয়ে বিলের প্রকৃত জমির মালিকদের বঞ্চিত করে লুটপাট ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। তারা বিলের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করে পুলিশ, গণসাধ্যম কর্মীসহ প্রশসানের বিভিন্ন স্তরে টাকা ঢেলে তাদেরকে ম্যানেজ করে এলাকার নিরীহ জনগনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া শুরু করেছে। এলাকার ভুক্তভোগি ও জমির মালিকরা জানান, বর্তমানে বিল এলাকায় যে উত্তেজনা ও সহিংস অবস্থা শুরু হয়েছে তাতে করে যে কোন মুহুর্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেঁধে যেতে পারে। তাই আমরা এলাকায় শান্তি স্থাপনের জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়ে আবেদন করেছি।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বিল প্রকল্পের সভাপতি দ্বিপপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোকলেছুর রহমান দুলালের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেলেও সাবেক চেয়ারম্যান বিকাশ চন্দ্র ভৌমিক জানান, বিলে যাদের প্রকৃত মালিকানা রয়েছে তাদের সবাইকে এই প্রকল্প ভুক্ত করা হয়েছে। কাইকে বাদ দেওয়া হয়নি। তারা যে অভিযোগ করেছে তা ভিত্তিহীন।
এ বিষয়ে বাগমারা থানার ওসি নাছিম আহম্মেদ জানান, পুলিশ এখানে কোন পক্ষপাতিত্ব করেনি। ছিনতাই ও চাঁদাবাজির যে অভিযোগ হয়েছে তার তদন্ত চলছে। তবে জোক বিলের ঘটনা নিয়ে তারা যে হুমকি দিয়েছে তা স্পর্ষকাতর হওয়ায় ওই মামলায় দুজনকে আটক করা হয়েছে ।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাকিউল ইসলাম জানান, লিকরা বিলের প্রকৃত ঘটনা জানতে আমি দুইবার বিল এলাকা পরিদর্শন করেছি। উভয় পক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে প্রাথমিক নিস্পত্তিও করা হয়। নতুন করে কোন সমস্যার উদ্ভব থাকলে উভয় পক্ষকে আবারও আলোচনা করা হবে।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ