নাটোর প্রতিনিধি: নাটোরের গুরুদাসপুরে চলনবিল এলাকায রসুনের জমিতে সাথী ফসল হিসাবে বাংঙ্গী চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর এই বাঙ্গী কেনাবেচা করে কৃষকে মুখে ফুটেছে হাসি । সাঁথী ফসল হিসাবে গুরুদাসপুর এলাকায় বাংঙ্গী ও তরমুজের আবাদ হয়ে থাকে।
এসময় কৃষক-কৃষাণীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। মাঠে নেমেছেন পাকা বাঙ্গী তুলতে। বিস্তৃর্ণ মাঠের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু পিচ ঢালা সড়কের দু’পাশে সারি সারি করে রাখা হয়েছে ফল আর ফল। তুলে আনা এসব পাকা বাঙ্গী সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য। রসুনে ক্ষতি হলেও সাথী ফসল বাঙ্গীতে বাম্পার ফলনের পাশাপাশি দামও পাচ্ছেন বেশ ভাল। এতে রসুনের ক্ষতি পুষিয়ে লাভের আশাও করছেন চলনবিলের কৃষকরা।
দুরের ফরিয়ারা আগেই আসেন এলাকার বাঙ্গী কিনতে। পাকা বাঙ্গী বিক্রির পর দুপুর থেকে তুলনামূলক কাঁচা ও আধাপাকা বাঙ্গী ট্রাকে লোড শুরু হয়। এগুলো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেওয়া হয়। এভাবেই প্রতিদিন চলনবিলের বিভিন্ন উপজেলার গ্রামে গ্রামে জমে উঠেছে কাঁচা-পাঁকা বাঙ্গী বেচাকেনা।
রসুনের জমিতে সাথী ফসল বাঙ্গী চাষ করে লাভবান হচ্ছে এই এলাকার কৃষকরা। বিগত প্রায় ৭ বছর ধরে অনেকটা বিনা খরচে এ আবাদ লাভ জনক হওয়ায় বাঙ্গী চাষের প্রতি কৃষকের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলছে। উৎপাদিত এই বাঙ্গী স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
বাঙ্গী চাষ করার জন্য আলাদা করে জমির দরকার হয় না। রসুন চাষের জমিতেই বাঙ্গী বীজ বপন করতে হয়। রসুন উঠে যাওয়ার পরই বাঙ্গীর গাছ ছড়িয়ে পড়ে ক্ষেতে। তখন সামান্য সেচ ও কীটনাশক দিয়ে যতœ নিলেই গাছে গাছে ফুল ও ফল ধরতে শুরু করে। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ধরে থাকা বাঙ্গী তুলতে শুরু করে কৃষক।
কৃষকরা জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে রসুনে ভাল ফলন হলেও আশানুরুপ দাম না পাওয়ায় আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় কৃষক। ফলে অনেকটা বিনা খরচে অধিক লাভ জনক হওয়ায় রসুনের লোকসান পোষাতে বাঙ্গী চাষে ঝুঁকছে এ অঞ্চলের কৃষক। তবে এবছর রসুনেও ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাঙ্গীতে আশানুরুপ দাম পাওয়ায় বেশ খুশি তারা। চলনবিল এলাকায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০-৫০টি ট্র্যাক বাঙ্গী লোড করা হয়। প্রতিটি ট্র্যাকে তিন থেকে চার হাজার পিছ বাঙ্গী লোড করা হয়। এতে ট্র্যাক প্রতি প্রায় ১লাখ থেকে দেড় লাখ টাকার বাঙ্গী নিয়ে যায় ব্যাপারিরা। এ অঞ্চল থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকার বাঙ্গী সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দুরের ব্যাপারিরা কৃষকের ক্ষেত থেকে ১শ পিচ বাঙ্গী ৩৫শ থেকে ৪ হাজার টাকায় কিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করছেন ৪ থেকে সাড়ে ৪হাজার টাকায়। এছাড়া প্রতিদিন সকালে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাকা বাঙ্গী নিয়ে কৃষক বধূরা ফরিয়াদের কাছে খুচরা ও পাইকারীতে ডালি চুক্তিতে বিক্রি করছেন।
কৃষি অফিস সূত্রে জানাযায়, চলনবিলাঞ্চলে এ বছর ৪৫০ হেক্টর জমিতে বাঙ্গী ও ৫৭০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ করেছেন কৃষক। বিগত কয়েক বছর ধরে রসুনে ভাল দাম না পাওয়ায় একই জমিতে বিঘায় ৯-১২হাজার টাকা ব্যায়ে বাঙ্গী চাষ করছে এ অঞ্চলের কৃষক। এতে করে অল্প খরচে বাঙ্গী চাষে অধিক লাভ হওয়ায় রসুনের লোকসান পুষিয়ে আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছে তারা। তাছাড়া এ মৌসুমে প্রখর রোদ আর গরমের কারণে বাঙ্গীর চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেশি।
চলনালী গ্রামের কৃষক আরিফ হোসেন জানান, তিনি ৪ বিঘা জমিতে বিনা চাষে রসুন করেছিলেন। তিনি রসুনের দাম না পেয়ে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন। পরে কৃষি বিভাগের পরামর্শে রসুনের জমিতে সাথী ফল হিসেবে বাঙ্গী চাষ শুরু করেন। গত ৩ বছর বাঙ্গী বিক্রি করে বিঘা প্রতি প্রায় ৩০ হাজার টাকা করে লাভ হয়েছিল। এবার লাভটা আরো বেশী হবে বলে প্রত্যাশা করেন।
একই গ্রামের কৃষক আবেদ-শাহ জানান, রসুনের জমিতে বিকল্প ফসলের কথা ভাবতেই পারিনি। প্রতিবেশী একজন কৃষকের দেখা দেখি ১০বিঘা জমিতে বাঙ্গীর আবাদ শুরু করি। খরচ বাদেও প্রায় ৫ লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। এ বছর সাড়ে ১২বিঘা জমিতে বিনা চাষে রসুনের আবাদ করেছি। রসুনের ফলন ভাল না হলেও বাঙ্গীর ফলন ভাল হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৪০০ পিচ করে বাঙ্গী তুলে বিক্রি করছি। এবার রসুন বাদেও প্রায় দুই থেকে তিন লাখ টাকার বাঙ্গী বিক্রি করা যাবে বলে মনে করছি।
শিধুলী গ্রামের কৃষক আঃ ছালাম (৪০) বলেন, আমার ৬ বিঘা জমিতে বাঙ্গীর উৎপাদন হয়েছে। সার, কিটনাশক, সেচ ,সঠিক ভাবে পাওয়াতে বাঙ্গী উৎপাদনে তেমন বেগ পেতে হয়নি। রসুনের জমিতে সাথী ফল বাঙ্গী কৃষকের বাড়তি উপার্জনের আর্শীবাদ বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাঁদের মত শত শত কৃষক রসুনের জমিতে বাঙ্গী চাষ করে আর্থিক ভাবে ভাগ্য বদলে নাম লেখাচ্ছেন।
একদিকে রসুন ঘরে তোলা অন্যদিকে বাঙ্গীর ক্ষেত পাহারাসহ জমি থেকে বাঙ্গী তুলে ক্রেতাদের হাতে দিতে চলনবিলের কৃষক ও কৃষিবধুরা এখন ঘর ও মাঠে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। বৈশাখের উত্তাপে বাঙ্গী দ্রুত পেকে যাওয়ায় এই ব্যস্ততার যেন শেষ নেই। এই কাজে বসে নেই পরিবারের স্কুল- কলেজ গামী ছাত্র/ছাত্রীরাও।
চলনবিলে বাঙ্গিকে ঘিরে কাঁচা-পাকা সড়ক ও মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে পাইকারি বাঙ্গী বিক্রির মোকাম। বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের কল্যাণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রাক নিয়ে ছুটে আসছেন মহাজন ও ফরিয়ারা। তারা এসব পাইকারি মোকাম ও কৃষকের ক্ষেত থেকে পাইকারি দরে বাঙ্গী কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার ফরিয়ারা কমদামে কিনে স্থানীয় হাট-বাজার ও দূরের গঞ্জে নিয়ে বিক্রি করছেন।
ঢাকা থেকে আসা আসাদুল নামে একজন ব্যাপারি জানালেন, গুনগতমান ও অপেক্ষাকৃত কম দামে বাঙ্গী পাওয়ায় প্রতিদিন গড়ে ২ ট্রাক বাঙ্গী কিনে ঢাকার কাওরান বাজারে বিক্রি করেন। তিনি জানালেন আকার ভেদে প্রতিটি বাঙ্গী ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকায় কিনে তা ঢাকায় নিয়ে গড়ে ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা দামে বিক্রি করেন।
কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী রুহুল আমিন জানান, কম দামে দেখে শুনে ভাল বাঙ্গী কেনার জন্য চলন বিলের বাঙ্গী মৌসুম জুড়েই অবস্থান করেন তিনি। দেখে শুনে কিনে তা ট্রাকে করে সিলেট, চট্রগ্রাম, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মোকামে পাইকারি দামে বিক্রি করেন। এতে খরচ বাদে ট্রাক প্রতি তিনি প্রায় ১০ থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করেন। তারমত অসংখ্য মহাজন ও ফরিয়ারা প্রতিদিন ট্রাক ভরে ওই বাঙ্গী কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। পাশা-পাশি স্থানীয় ফরিয়ারাও মাঠ থেকে বাঙ্গী কিনে নছিমন, করিমন, ভুটভুটিতে ও ছোট মালবাহী ট্রাকে করে স্থানীয় আঞ্চলিক পর্যায়ের হাট বাজারে বিক্রি করছেন।
দূরের ব্যাপারীরা জানায়-আমরা এই মাল একটু কাঁচা থাকতেই ক্রয় করি কারণ আমাদের শহরে পৌঁছাতে অনেক দেরী হয়। বাঙ্গী গুলো আমরা বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে থাকি। পরে সেখান থেকে খুচরা ক্রেতাদের হাতে চলে যায়।
নাটোর জেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.রফিকুল ইসলাম বলেন, চলনবিলের বিনা চাষে রসুনের আবাদ হলেও অধিকাংশ কৃষক অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারনে সাথী ফসল চাষের প্রতি আগ্রহী ছিল না । ৫বছর আগে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করায়, কৃষক এখন সাথী ফল বাঙ্গী আবাদ করতে শুরু করেছে।। অনেকটা বিনা খরচে একই জমিতে বাঙ্গী চাষ অধিক লাভ জনক হওয়ায় চলন বিলের কৃষকদের ভাগ্য বদল শুরু হয়েছে। আগামীতে ব্যাপক ভিত্তিতে বাঙ্গী চাষ হবে বলে তিনি মনে করেন।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ