নজরুল ইসলাম জুলু : রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল বিভাগের ইন্টার্ন চিকিৎসক জাকির হোসেন অমিকে গত ১৫ জানুয়ারি রাত্রী আনুমানিক ৮টা ৩০মিনিটে চন্দ্রিমা থানাধীন ব্যাংক টাউন এলাকা থেকে
সিএনজিতে অপহরণের করা হয়। পরবর্তীতে অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে চন্দ্রিমা থানা এবং র্যাব-৫ এর যৌথ অভিযানে অভিযানিক দলের সদস্যরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অপহরণকারীদের অবস্থান চিহ্নিত করেন এবং মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে রাজপাড়া থানাধীন বিলশিমলা এলাকার রায়সা কমপ্লেক্সের একটি এ্যাপার্টমেন্টে থেকে দুই অপহরণকারীকে গ্রেফতার সহ অপহৃত চিকিৎসক অমিকে উদ্ধার করেন। গ্রেফতার হওয়া দুই অপহরণকারী হলো মো: আব্দুর রশিদ ও তার ড্রাইভার মো: মীম ইসলাম। এই ঘটনায় অপহৃতের
বাবা মো: আমির হোসেন সরদার ১৭ জানুয়ারি চন্দ্রিমা থানায় আব্দুর রশিদ ও মীম ইসলাম সহ অজ্ঞাতনামা ২/৩ জন কে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন যাহার মামলা নং ১০(চন্দ্রিমা থানা)। অনুসন্ধানে জানা যায়, অপহরণকারী আব্দুর রশিদের রায়সা কমপ্লেক্স নামে বিলশিলা এলাকায় দুটি ভবনের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। তিনি বোয়ালিয়া থানাধীন উপশহর এলাকার মহসিনের ছেলে,তার গ্রামের বাড়ি গোদাগাড়ী। মীম আব্দুর রশিদের ব্যক্তিগত ড্রাইভার। সে রাজপাড়া থানার ডিঙ্গাডোবা এলাকার মো. মোশারফের ছেলে। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ জানুয়ারি দিনগত রাত আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে অমি
সিএনজি অটোরিকশাযোগে গ্রামের বাড়ি বাগমারা থেকে শহরের ছোট বনগ্রামের বাসায় ফিরছিলেন। বাসায় প্রবেশের সময় ৬ থেকে ৭ জনের একটি সশস্ত্র দল তাকে অপহরণ করে আব্দুর রশিদের বিলশিমলার এ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যায়। অপহরণকারীরা তার কাছ থেকে ব্যাংকের চেক ও ফাঁকা স্ট্যাম্পে জোর করে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। এরপর তাঁর কাছ থেকে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকার মুক্তিপণ দাবিতে তাকে আটকে রেখে মারধর করে । ঘটনাটি জানতে পেরে অমির স্ত্রী মিথিলা পারভিন র্যাব-৫ ও চন্দ্রিমা থানায় অভিযোগ করেন। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানে তাকে উদ্ধার করা হয়।
অপহরণের নেপথ্যের কারণ :
ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ দীর্ঘদিন কাতারে রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন। কাতারে একজন ব্যবসায়ীর বিপুল টাকা আত্মসাৎ করে দেশে চলে আসেন তিনি। এরপর নগরীর উপশহর এলাকায় বসবাস শুরু করেন এবং জমির ব্যবসা করেন। দেশে ফিরে আসার পর আওয়ামী লীগ নেতা ওমর ফারুকের সাথে বিভিন্ন সূত্রে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। ওমর ফারুকের ছত্রছায়ায় রশিদ মাদক ব্যবসা করে বিপুল অর্থের মালিক হোন। কিন্তু, পরবর্তীতে ওমর ফারুকের সাথে মনকষাকষি হওয়ার পর রশিদ পলাতক সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তার ছত্রছায়ায় মাদক ব্যবসা চালু রাখেন।
লিটনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় লিটনের সহযোগিতায় দলীয় প্রভাব খাটিয়ে রশিদ বিভিন্ন এলাকার বিরোধপূর্ণ ও খাসজমি দখল নিয়ে বহুতল ভবন তৈরি করে ফ্ল্যাট ও প্লট বিক্রি শুরু করেন। নিজেকে জমি ব্যবসায়ী ও ডেভেলপার পরিচয় দিলেও আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি হুন্ডি ও মাদক ব্যবসার সাথেও জড়িত। লিটনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নকল দলিল তৈরির মাধ্যমে খাস জমি দখল সহ নানান অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে তিনি শত শত কোটি টাকার সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে তার ডাবতলা এলাকায় তিনটি বহুতল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে আব্দুর রশিদের
বিলশিমলার রায়সা কমপ্লেক্সের একটি এ্যাপার্টমেন্টে রয়েছে টর্চার সেল। উল্লেখ্য রশিদের মালিকানাধীন রায়সা কমপ্লেক্সের একটি এ্যাপার্টমেন্ট থেকেই অপহৃত অমিকে উদ্ধার করা হয়। লিটনের সহযোগিতায় বিপুল অর্থ সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া রশিদ ছিলেন লিটনের অর্থের যোগান দাতা। আওয়ামী লীগের কোনো পদে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও লিটন ও আওয়ামী লীগ কে নিয়মিত অর্থের যোগান দিতেন রশিদ। অন্যদিকে, অপহরণের শিকার জাকির হোসেন অমি রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। মাদকাসক্তি ও টাকার বিনিময়ে কমিটি দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর তাকে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে লোকদেখানো অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। অমির সাথেও পলাতক সাবেক মেয়র লিটনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অনুসন্ধানে জানা যায় জাকির হোসেন অমি ও আব্দুর রশিদ ব্যবসায়ীক পার্টনার ছিলেন।
তারা দুইজনেই লিটনের আস্থাভাজন হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন এলাকার বিরোধপূর্ণ ও খাস জমি ক্রয় করে ফ্ল্যাট ও প্লট করে বিক্রি করতেন। গত ৫ আগস্টের আগে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অমি এসব কাজে রশিদকে দলীয়ভাবে সহযোগিতা করতেন। রশিদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো থেকে আরও জানা গেছে, রশিদ ও অমি নগরীর ডাবতলা ও জিন্নানগর এলাকার বিরোধপূর্ণ দুটি জমি সাবেক মেয়রের প্রভাব খাটিয়ে দখলে নেন। এই জমি দখল বাবদ সাবেক মেয়র ও স্থানীয় কাউন্সিলরসহ কয়েকজনকে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। এই টাকাটা প্লট বিক্রির মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছ থেকে তুলে নেন অমি। তবে গত ৫ আগস্ট সাবেক মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা আত্মগোপন করায় এই টাকার ভাগ অমি আর কাউকে দেয়নি। রশিদ বিষয়টি সম্প্রতি জানতে পেরে টাকা উদ্ধারের জন্য অমির ওপর চাপ দেওয়া শুরু করে। প্লট, মাদক ও হুন্ডির টাকার ভাগাভাগি সংক্রান্ত বিরোধ থেকেই এই অপহরণের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রশিদকে বাঁচাতে পলাতক সাবেক মেয়র লিটনের তদবির:
এইদিকে নিজের অর্থের যোগানদাতা ও ঘনিষ্ঠভাজন রশিদকে বাঁচাতে এবং রশিদ ও অমি’র মধ্যকার চলমান বিবাদের মীমাংসা করতে বিদেশের মাটিতে বসেই লিটন বিভিন্ন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে থানায় তদবির করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র মোতাবেক, লিটন স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত এর কয়েকজন নেতার সহায়তায় রশিদ কে উক্ত অপহরণ মামলা থেকে বাঁচাতে থানায় ব্যাপক তদবির চালাচ্ছেন। রশিদের জন্য সুদূর বিদেশে পলাতক থেকেও লিটনের তদবির প্রমাণ করে রশিদের সাথে তার এখনো যোগাযোগ বিদ্যমান।
এইদিকে চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিউর রহমান বলেন, অপহরণ চক্রের মূলহোতা আব্দুর রশিদ ও তার গাড়ি চালক মীম ইসলামকে আদালতে চালান করা হয়েছে। অপহরণের সঙ্গে জড়িত বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
তিনি আরও বলেন, রশিদ নিজেকে ডেভেলপার পরিচয় দিলেও সে মূলত কুখ্যাত মাদক ও হুন্ডি ব্যবসায়ী। তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আশা করছি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করা সম্ভব হবে।
নই