একটি চক্র অভিনব কৌশলে একই ফ্ল্যাট একাধিক ব্যাংকে মর্টগেজ রেখে লোনের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। বিষয়টি এতদিন গোপন থাকলেও সম্প্রতি সিআইডির এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এই ঘটনায় চক্রটির ১১ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।
শুক্রবার (৩ মে) অভিযান চালিয়ে তাদের কাছ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরিকৃত একই ফ্ল্যাটের একাধিক নকল দলিল ও দলিল রিসিট, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিলমোহর, একই ব্যক্তির একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র, টিন, ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডসহ নগদ তিন তিন লাখ টাকা জব্দ করা হয়।
এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড জয়নাল আবেদীন নামে এক ব্যক্তি। তিনিসহ গ্রেফতার চক্রের প্রধান ব্যক্তিরা হলেন প্রধান সহযোগী রাকিব হোসেন (৩৩), জয়নালের ভায়রা ভাই এম মোস্তাফিজুর রহমান (৫৪), জাল কাগজপত্র ও এনআইডি প্রস্তুতকারক লিটন মাহমুদ (৪০), ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল প্রস্তুতকারক হাবিবুর রহমান ওরফে মিঠু (৩০), ব্যাংক কর্মকর্তা হিরু মোল্যা (৪৪), আব্দুস সাত্তার (৫৪) ও সৈয়দ তারেক আলী (৫৪)।
সিআইডি বলছে, এখন পযর্ন্ত চক্রটির ১১ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, এই চক্রের সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন পরিদফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও দালাল, ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন অসাধু কর্মী জড়িত।
শনিবার (৪ মে) দুপুরে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া।
সিআইডি প্রধান জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন পরিদফতরের কিছু অসাধু সদস্যের সক্রিয় সহযোগিতায় চক্রের সদস্যদের নামে একাধিক সক্রিয় জাতীয় পরিচয়পত্র ও কর দেওয়ার টিন তৈরি করা হয়। পরে এসব ব্যবহার করে চক্রের সদস্যরা ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের কিছু অসাধু লোকের মাধ্যমে নিজেদের নামে ফ্ল্যাট/জমির একাধিক মূল দলিল তৈরি করত। এরপর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে তৈরিকৃত একাধিক দলিল দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মর্টগেজ রাখত। শেষে একটি ফ্ল্যাটের বিপরীতে একাধিক লোন গ্রহণ করত। এখন পর্যন্ত তারা এমন প্রতারণা করে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে সিআইডির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
মোহাম্মদ আলী মিয়া জানান, এই সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের মূল হোতা জয়নাল আবেদীন ওরফে ইদ্রিস। তারা রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ক্রেতা হিসেবে হাজির হতেন। সেই ফ্ল্যাট কেনার জন্য শুরুতে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বায়না করতেন। এরপর ফ্ল্যাটের মালিকানার তথ্য যাচাইয়ের কথা বলে মালিকের কাছ থেকে দলিল এবং অন্যান্য কাগজপত্রের কপি সংগ্রহ করতেন। ফ্ল্যাটের মালিকের কাছ থেকে নেওয়া দলিল এবং অন্যান্য কাগজপত্রের তথ্য নিয়ে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের কিছু অসাধু লোকের মাধ্যমে তৈরি করা হতো জাল দলিল।
জয়নাল আবেদীন ওরফে ইদ্রিস জাল দলিলে কখনো নিজে মালিক হতেন, আবার কখনো চক্রের অন্যান্য সদস্যদের মালিক বানাতেন। এরপর সেই জাল দলিল দিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রির ফাঁদ পাততেন তারা। ফ্ল্যাট পছন্দ হলে ক্রেতার কাছ থেকে বায়না বাবদ অগ্রিম টাকাও নিতেন জয়নাল। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে রেজিস্ট্রিকৃত ক্ষমতা অর্পণ দলিল দেখিয়ে ক্রেতার নামে ব্যাংক ঋণ নিয়ে সেই টাকাও আত্মসাৎ করতেন। এভাবে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ফ্ল্যাটের জাল দলিলে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নিয়েছে শত কোটি টাকা।
সিআইডির অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, চক্রটির প্রতারণায় ঢাকার অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট বিক্রির ফাঁদে পড়ে পথে বসেছেন বহু ফ্ল্যাট মালিক। পাশাপাশি সম্ভাব্য ফ্ল্যাট ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা এবং ব্যাংক ঋণের বোঝা চাপিয়ে তাদের নিঃস্ব করেছেন তারা।
জাল দলিলে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা পেয়ে জয়নাল আবেদীনের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান রুমানা জুয়েলার্স, নীড় এস্টেট প্রোপার্টিস লিমিটেড, হোসেন এন্টারপ্রাইজ, ই আর ইন্টারন্যাশনালসহ চক্রের ২৫ জন সদস্যের বিরুদ্ধে ডিএমপির উত্তরা-পূর্ব থানায় মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করেছে সিআইডি।
বিএ…