সময়ের আগেই নওগাঁর ছোট যমুনাসহ কয়েকটি নদীর পানি কমে গেছে। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নদীর পানি দিয়ে চাষাবাদ করা চাষিরা। নদীর ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরাও ঝুঁকছেন ভিন্ন পেশায়। নদী খনন করা হলে নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষি, জীবন-জীবিকা ও প্রাণিজ সম্পদ রক্ষা পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁয় ইরি-বোরো রোপণ ও পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। তবে সময়ের আগেই পানি কমে যাওয়ায় নদীকেন্দ্রীক জমিতে বোরো চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা। বৃষ্টির পরিমাণ কম হওয়ায় বিগত বছরের তুলনায় ছোট যমুনা, আত্রাই, তুলসিগঙ্গা ও মহানন্দা নদীর পানি দ্রুত কমছে। কোথাও কোথাও নদী শুকিয়ে গেছে। এ চারটি নদীর পানি দিয়েই প্রায় ১০-১৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো আবাদ হয়ে থাকে। এছাড়া বছরের অন্য সময় গম, আলু, পাট, সরিষা ও শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসলও হয়ে থাকে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে বেশ কিছু নদীকেন্দ্রীক এলএলপি (ভাসমান সেচ পাম্প) পানি না পেয়ে বন্ধ হয়ে যাবে।
এক সময় ভরা যৌবন জোয়ারে পরিপূর্ণ ছোট যমুনা নদীতে পালতোলা বাদামের নৌকা চলতো। বণিকরা বাণিজ্যের জন্য জয়পুরহাট ও নাটোর জেলা থেকে আসতেন। নদীকে কেন্দ্র করেই ছিল জীবন জীবিকা। নদীর পানি দিয়ে হতো আবাদ। খরস্রোতা সেই নদীটি শুকিয়ে এখন যৌবন হারিয়েছে। কোথাও সামান্য পানি থাকলেও অধিকাংশ জায়গায় নদীর বুকে এখন ঘাস গজিয়েছে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) তথ্যমতে, জেলায় ৪ হাজার ১০৩টি গভীর নলকূপের আওতায় প্রায় ৯৮ হাজার হেক্টর জমি এবং ১৯৬টি এলএলপির (ভাসমান সেচ পাম্প) আওতায় প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমির বোরো আবাদ হয়।
চাষিরা বলছেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া এবং পলি পড়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এতে বর্ষা মৌসুমে নদী উপচে পড়ে এবং শুষ্ক মৌসুমে দ্রুত পানি কমে শুকিয়ে যায়। সার, তেল, শ্রমিকের মজুরি ও কীটনাশকের দাম বাড়ায় বোরো আবাদে খরচও বেড়েছে। চারা রোপণ থেকে শুরু করে ধান ঘরে ওঠানো পর্যন্ত বিঘাতে প্রায় ১৪-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। খরচ বাড়লেও সে তুলনায় লাভ হয় না।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) গভীর নলকূপে এলাকা ভেদে প্রতি বিঘা জমিতে পানি ১৪০০-১৮০০ টাকা এবং এলএলপিতে (ভাসমান সেচ পাম্প) প্রতি বিঘা জমিতে ২০০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকা নিচ্ছেন পাম্প মালিকরা।
সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নে ইকড়তাড়া গ্রামের এলএলপি মালিক তুষার বলেন, ছোট যমুনা নদীর পানি দিয়ে গত পাঁচ বছর থেকে নলকূপটি পরিচালনা করে ১০০ বিঘা বোরো জমি করছেন। এছাড়া অন্যান্য ফসলেও পানি সেচ দেওয়া হয়। তবে এবার একমাস আগেই নদীর পানি অনেক কমে গেছে। আরও দুইমাস জমিতে সেচ দিতে হবে। যদি নদী শুকিয়ে যায় গভীর নলকূপ খনন করতে হবে। এতে আবাদে খরচও বেশি পড়বে। পানি কমায় দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন তারা।
সদর উপজেলার ভবানিপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, নদীকে কেন্দ্র করেই আমাদের জীবন জীবিকা। গত ১৫-২০ বছর আগেও নদীতে প্রচুর মাছ ধরা পড়তো। এ মৌসুমে নদী থেকে এখন খাওয়ার মাছ পাওয়াও কষ্টকর হয়ে উঠেছে। এ নদীর ওপর নির্ভর করে থাকলেতো আমাদের সংসার বা জীবন চলবে না। কেউ রিকশা-ভ্যান চালাচ্ছে, আবার কেউ কৃষিকাজ বা দিনমজুরির পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। নদী খনন করা হলে মৎস্যজীবীরা বাঁচবেন এবং ফসলও রক্ষা পাবে।
নদীর পানি দিয়ে আবাদ করা কৃষক মোকলেছুর রহমান বলেন, ছোট যমুনা নদীর পানি দিয়ে সারা বছরই চাষাবাদ করা হয়। চার বিঘা জমিতে বোরো লাগানো হয়েছে। নদীর পানি দিয়ে আবাদ করায় খরচ কিছুটা কম পড়ে। এখন পানির দরকার কিন্তু নদী শুকিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন নদী খনন না করায় নদীর তলদেশ পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। নদীর কোথাও কোথাও শুকিয়ে ঘাস গজিয়েছে। আবার যখন পানির দরকার নেই তখন বাঁধ উপচে পড়ে যায়। ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়।
তিলোকপুর গ্রামের কৃষক কাশেম আলী বলেন, সবধরনের সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের দাম বেড়েছে। বোরো আবাদে খরচ কমপক্ষে ৩-৪ হাজার টাকা বেড়েছে। চারা লাগানো থেকে শুরু করে ঘরে ওঠানো পর্যন্ত ১৪-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। আবাদ করতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে সে তুলনায় লাভবান হওয়া যাচ্ছে না। জমিতো ফেলে রাখা যায় না। ধানের দাম যদি ১৫০০ টাকা মণ থাকে কিছুটা লাভবান হওয়া যাবে।
নওগাঁ রিজিয়ন-১ বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বরেন্দ্রর আওতায় ভূগর্ভস্ত এবং ভূউপরস্থ পানি দিয়ে সেচ প্রদান করা হয়। ছোট যমুনা, আত্রাই, তুলসিগঙ্গা ও মহানন্দা নদীর পানি দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর কারণে আত্রাই উপজেলার শুটকিগাছা এলাকায় রাবার ড্যাম নষ্ট হওয়ায় পানির স্তুর নিচে নেমে যাচ্ছে। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই, বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে জরুরি ভিত্তিতে গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচ কাজ পরিচালনা করা হবে।
বিএ