মার্চ আমাদের গৌরবের মাস, মার্চ আমাদের অহংকারের মাস, মার্চ আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার মাস। মার্চ আনুষ্ঠানিক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাস। এ মাসেই বাঙালি অর্জন করে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। আজ ১ মার্চ, মহান স্বাধীনতার মাসের প্রথম দিন।
১৯৭১ সালের এই মাসে তীব্র আন্দোলনের পরিণতিতে শুরু হয় মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ। বাংলার আন্দোলন-সংগ্রামের ঘটনাবহুল ও বেদনাবিধুর স্মৃতি বিজড়িত ১৯৭১-এর এই মার্চ মাসেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে এসে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা হলেও চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই।
আজকের এই দিনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের সাধারণ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। মুহূর্তে গর্জে উঠে পুরো দেশ। পূর্ববাংলার ছাত্র সমাজ ও সাধারণ মানুষ স্লোগান তুলে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’
১৯৭১ সালের মার্চে শুরু হয় স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লড়াই-সশস্ত্র সংগ্রাম। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর লাল-সবুজ পতাকার দেশ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটে।
দীর্ঘদিন ধরে এদেশের শোষিত, নিপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত মানুষ স্বাধিকারের জন্য লড়াই করে আসছিল। মহান ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল জাতিসত্তার স্বরূপ অন্বেষার এক একটি মাইলফলক। সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা ষড়যন্ত্র ও টালবাহানা করছিল।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করেন। এ অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল ৩ মার্চ। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ গোটা পাকিস্তানেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার হীন, কূট ষড়যন্ত্র হিসেবে অধিবেশন বাতিলের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্রোধে, ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে।
১৯৭১-এর ৭ মার্চ সাবেক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এ সময় পাকিস্তানি শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। মরতে যখন শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তার ঘোষণার পর বীর বাঙালি সেই যে ঘর থেকে বেরিয়েছিল, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আর ঘরে ফেরেনি। এরপর একে একে পার হয় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ২৫টি দিন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ চালায়, শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে অগণিত প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়েছে, অগণিত মা-বোনকে হারাতে হয়েছে সম্ভ্রম। আহত ও পঙ্গু হতে হয়েছে এদেশের অগণিত মানুষকে। লাখো মানুষের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বাঙলার দামাল ছেলেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনেন একটি স্বাধীন দেশ—গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
মার্চ মাসেই বাঙালি জাতি তার চেতনাকে নতুন করে শাণিত করে। নতুন শপথে বলীয়ান হয়। অত্যাচার, নিপীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্মারক মাস হিসেবে মার্চ প্রতিবারই আমাদের নতুন করে পথ দেখায়।
এবারের মার্চ এবং স্বাধীনতা দিবস ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন আমেজে পালিত হবে। এবার একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে একযোগে। এই দুটি মাহেন্দ্রক্ষণ একযোগে উদযাপনের কর্মসূচি আগের বছর শুরু হলেও মহামারির করোনার কারণে জাঁকজমকভাবে উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মেয়াদ চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত করেছে। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতির প্রেক্ষাপটে শেষ সময়ের অনুষ্ঠান ঘটা করে পালিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো ভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
বিএ/