রাজশাহীর নারী নির্যাতন ও ভ্রূণ হত্যা মামলার প্রধান আসামি আজহার আলী আপেলকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকা থেকে আটক করা হয়েছে। আপেল কুয়েতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে বিমানবন্দরে প্রবেশের সময় ইমিগ্রেশনে আটক হয়। আটক আপেল নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানাধীন শিরোইল এলাকার জাবেদ আলীর ছেলে। আজ শনিবার দুপুরে তাকে আটক করা হয়। এ মামলাটির তদন্তভার গত দুইদিন আগে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা শাখায় যায়। তার আগে দীর্ঘদিন ধরে নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় মামলাটি ছিল। তদন্তের অগ্রগতিতে বাদী তাজনুভা তাজরিন সন্তুষ্ট না হওয়ায় তিনি গত ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৭ তারিখ রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর অভিযোগ করেন।
সেখানে বাদী তাজনুভা তাজরিন অভিযোগ করেন, ২০২০ সালের ২১ মে তিনি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নগরীর বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৬ জন আসামি থাকলেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। মামলার ১ নাম্বার আসামী আজাহার আলী আপেল বিদেশ পালিয়েছে বলে বোয়ালিয়া থানা পুলিশ তাকে জানায়। অথচ বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার কোন প্রমাণ পাচ্ছেন না। পরে আসামিরা আদালতে জামিন নেন প্রধান আসামী ছাড়া। মামলার আসামীরা তাকে হুমকি দেয়।
আরো বিভিন্ন অভিযোগ করে মামলাটির সুষ্ঠ তদন্ত ন্যায্য বিচার চান। এরপর চলতি মাসের ১৪ তারিখে তিনি মামলাটি ডিবির কাছে স্থানান্তরের জন্য আবেদন করেন। সেই আবেদনে বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পুলিশের পক্ষপাতমুলক আচরণের কারণেই তিনি মামলাটির তদন্তভার ডিবিতে দেয়ার জন্য আবেদন করেন। তার আবেদনের পরে গত দুইদিন আগে মামলাটি ডিবিতে পাঠানো হয়। মামলাটি ডিবিতে আসার পর ডিবির পক্ষ থেকে বিষয়টি ঢাকা বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। আজ দুপুরে প্রধান আসামি আজাহার আলী আপেল কুয়েতে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে আটক হয়। আটকের পর তারা রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে বিষয়টি জানায়। এরপর দুপুরেই ডিবির একটি টিম আসামিকে নিতে ঢাকা বিমানবন্দরের রওনা দেই। এখন তারা ঢাকায় অবস্থান করছেন।
এ তথ্য নিশ্চিত করে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার আরেফিন জুয়েল বলেন, গত দুইদিন আগে মামলাটির ডিবিতে এসেছে । এরপর আমরা ঢাকা বিমানবন্দরে তার তথ্য পাঠিয়েছিলাম। আজ কুয়েতে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের হাতে আপেল আটক হলে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আমাদের কে জানাই। বিষয়টি জানার পরেই তাকে নিতে ঢাকায় ডিবির একটি টিম পাঠানো হয়েছে। আসামি নিয়ে আসলে তাকে আদালতে পেশ করা হবে। আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
উল্লেখ্য, এর আগে নির্যাতনের একটি মামলা করেছিলেন গৃহবধূ তাজনুভা তাজরীন। সেই মামলার কোন আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। নির্যাতনের কারণে গর্ভপাত হলে ভ্রূণ হত্যার আরেকটি মামলা করেন তিনি। এ মামলারও কোন আসামি গ্রেপ্তার হননি। উল্টো তাজনুভা তাজরীনের বিরুদ্ধেই একটি মামলা হয়। তাজনুভা তাজরীনের দাবি, মামলাটি ‘গায়েবি’। মামলার বাদীকে তিনি চিনেননা।
রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানায় গত ১৭ জানুয়ারি মামলাটি দায়ের হয়েছে। মামলার বাদীর নাম আতিক আহমেদ। এজাহার অনুযায়ী, তার বাড়ি নগরীর চন্দ্রিমা থানার নামোভদ্রা এলাকায়। ৭৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে ফেরত না দেয়ার অভিযোগে তিনি মামলাটি দায়ের করেছেন। এজাহারে দেয়া মোবাইল নম্বরে মামলার বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কোন কথা বলতে চাননি।
ভুক্তভোগী তাজনুভা তাজরীন নগরীর শিরোইল এলাকার মৃত ইব্রাহীম আলী দেওয়ানের একমাত্র কন্যা। নগরীতে তাজনুভার রেস্তোরাঁর ব্যবসা ছিল। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর একই এলাকার আজাহার আলী আপেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। দুজনেরই এটি দ্বিতীয় বিয়ে। আজাহার আলী কাতারে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে চাকরি করেন। দেশে ফিরে বিয়ে করেছিলেন।
তাজনুভা জানিয়েছেন, তার স্বামী আপেল ছিলেন মাদকাসক্ত। বিয়ের পরদিন থেকেই মারধর করতেন। বিয়ের আগে ও পরে যৌতুক হিসেবে চার লাখ টাকা নিয়েছেন আপেল। আরও ১৫ লাখ টাকার জন্য নির্যাতন করতেন। ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তখন তিনি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কয়েকদিন পর আপেল ডিভোর্স লেটার পাঠান। এরপর তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তাজনুভা স্বামীর ডিভোর্স লেটার গ্রহণ করেননি। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তিনি বাবার বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। ১৬ মার্চ শাশুড়ি মোতাহারা বেগম জেনি তাকে ফোন করে বলেন, যা হবার হয়েছে। এখন তারা একসঙ্গেই থাকতে চান।
তাজনুভা বলেন, ‘আমি আমার সংসারের কথা বিবেচনা করে শাশুড়ির কথায় সাঁই দিয়ে ওই বাড়িতে যাই। কিন্তু শাশুড়ি সেদিন আমাকে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে গর্ভপাতের ওষুধ খাইয়ে দেন। সন্ধ্যা থেকে আমার রক্তপাত শুরু হয়। পরদিন আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করেন। চিকিৎসকরা আমাকে জানান, বাচ্চাটা টিকবে না। এরপর আমি আমার স্বামী-শাশুড়িসহ ছয়জনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করি।’
পরবর্তীতে তাজনুভার পেটের সন্তানের যখন বয়স সাড়ে চার মাস তখন তার গর্ভপাত ঘটে। এ ঘটনায় গত বছরের ৩১ আগস্ট তাজনুভা শাশুড়িসহ চারজনকে আসামি করে ভ্রূণ হত্যার অভিযোগে আদালতে আরও একটি মামলা করেন। দুটি মামলার একজন আসামিকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি।
ভ্রূণ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বোয়ালিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল মতিন এরই মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দেন যে, মামলাটির সত্যতা পাওয়া যায়নি। অথচ আদালতের নির্দেশে পুলিশ সাড়ে চার মাস বয়সী অপূর্ণ বাচ্চাটির লাশ তুলে ডিএনএ সংগ্রহ করেছে। ডিএনএ’র রিপোর্টও আদালতে পৌঁছেছে।
এতে বলা হয়েছে, বায়োলজিক্যালি বাচ্চাটার মা তাজনুভা। তাই তাজনুভা পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর আদালতে ‘নারাজি’ দিয়েছেন। আগামী মার্চে মামলার নির্ধারিত দিনে আদালত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। এরই মধ্যে তাজনুভার বিরুদ্ধে বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা করা হয়।
তাজনুভা বলেন, নারী নির্যাতন মামলার ছয় আসামির মধ্যে চারজন জামিন নিয়েছেন। এবার স্বামীও আটক হয়েছে। এছাড়া কোহিনুর বেগম চন্দ্রা নামে তার আরেক ননদ জামিন নেননি। তিনি ঢাকায় থাকেন। পুলিশ এদের গ্রেপ্তারের কোন চেষ্টা করেনি। বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিবারন চন্দ্র বর্মন এর আগে বলেছিলেন, মামলার মূল আসামি হলেন তাজনুভার স্বামী। মামলা দায়েরের আগেই তিনি বিদেশে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। তাই তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। আর অন্য আসামিদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে। আর তাজনুভার বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে সেটি অন্য এক ব্যক্তি করেছেন। সে মামলাটিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
জেএন