নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) আব্দুল লতিফকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাময়িক বরখাস্ত করে বরিশাল রেঞ্জের সংযুক্ত করা হয়েছে। ২ নভেম্বর পুলিশ মহাপুলিশ পরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ এ বরখাস্তের আদেশ দেন ।
জানা গেছে, আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ এর বিরুদ্ধে যোগসাজশ করে পছন্দের লোককে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া, বদলিজনিত তদবিরসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ গড়েছেন এমন অভিযোগে পুলিশ হেডকোয়ার্টার এর পক্ষ থেকে তদন্ত শুরু হয়। পুলিশ সুপার
পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এ তদন্ত করেন। এর জের ধরে গত মাসে তাকে অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক মাইনুর রহমান চৌধুরী (প্রশাসন) পুলিশ হেডকোয়ার্টারে তলব করেন। কিন্তু তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় ও তার বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এরপর তাকে বরিশাল রেঞ্জের সংযুক্ত করা হয়। আরএমপির মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস এর একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে আরএমপির দায়িত্বশীল এক পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল লতিফকে সাময়িক বরখাস্তের তথ্যটি নিশ্চিত করেন। এ ব্যাপারে আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি
উল্লেখ্য, একজন কেরানি হয়েও আব্দুল লতিফ নামে-বেনামে ও নিজ এলাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ বাড়ি-গাড়ি করেছেন এমন অভিযোগে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি ছিলেন আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিফ আরএমপিতে যোগ দেয়ার পর বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি বাণিজ্য, পদোন্নতি, থানা থেকে মাসোহারা তোলা, নিয়োগ, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেয়া, মালামাল না কিনেই বিল উত্তোলন এবং ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজস করে তিনি নিজেও কাজ করে এসব সম্পদ অর্জন করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৭ সালে আবদুল লতিফ প্রধান সহকারী হিসেবে আরএমপিতে আসেন। এ পর্যন্ত তিনি চতুর্থ শ্রেণির ১৪ জন কর্মচারী নিয়োগ করেছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে নিয়েছেন ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। আরএমপির ১২টি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) অন্যদের বদলি ও পদায়নের ‘গুরুদায়িত্ব’ পালন করেন তিনি। এ কারণে থানার ওসিরা তাকে ‘বড় ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। লতিফ আরএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামে প্রতিটি থানা থেকে নেন মাসোহারা।
২০১৭ সালে আবদুল লতিফ একদিনেই ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের নিজনামীয় হিসাব থেকে ৪০ লাখ টাকা এবং তার গৃহিণী স্ত্রীর হিসাব থেকে ৫৮ লাখ টাকা তোলার জন্য চিঠি দেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি জানতে পারলে একজন কর্মচারীর এত টাকার বিষয়ে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দেয়। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময় ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে সবকিছু ম্যানেজ করেন লতিফ।
আরএমপির এই কর্মচারীর মহানগরীর আলীগঞ্জ মৌজায় প্রায় দুই কোটি টাকার ১০ কাঠা জমি, কাজিহাটা মৌজায় আড়াই কোটি টাকার চার কাঠা জমি, নাটোর শহরে আড়াই কোটি টাকা মূল্যের ১০ কাঠা জমি, নাটোরের বাগাতিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে দুই কোটি টাকার ৪০ বিঘা জমি এবং ঢাকায় দুই কোটি টাকার দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া নামে-বেনামে রাজশাহী শহরে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি।
দরপত্র আহ্বান করলেও সকল ঠিকাদারকে সিডিউল না দেয়া আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিফের একটি অভ্যাস। তিনি ২০১৫ সাল থেকে বেশিরভাগ মেরামত ও সংষ্কার কাজ, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা থেকে শুরু করে আরও অনেক কাজ চারঘাটের সারদার আবদুর রহমান মুন্না নামে এক ঠিকাদারের মাধ্যমে করছেন। এই ঠিকাদারের পরিবারের সদস্যদের নামে ১০-১২টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি জালিয়াতি করে এই ঠিকাদারকে তিনি কাজ দিয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হলে লতিফের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। কিন্তু তিনি এখনও আরএমপিতে বহাল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত আরএমপিতে মেরামত ও সংষ্কার কাজ হয়েছে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার। যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা হয়েছে ১১ কোটি টাকার। এসব মেরামতে ব্যয় করা হয়েছে ৫৭ লাখ টাকা। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামে ব্যয় হয়েছে ১৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, মেরামত ও সংষ্কার কাজের ৩০ ভাগ কাজ করে বাকিটা লুটপাট করেছেন লতিফ ও তার মনোনিত ঠিকাদার। যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়েছে বাজারদরের চেয়ে অধিক মূল্যে। আর্চওয়ে গেটের বাজার মূল্য ৭০ হাজার টাকা থাকলেও সিডিউল মূল্য ছিল তিন লাখ ২০ হাজার টাকা। সাড়ে তিন হাজার টাকার সিসি ক্যামেরার সিডিউল মূল্য ছিল ১২ হাজার টাকা। এছাড়া ৫০-৫২ হাজার টাকা দামের কম্পিউটার কেনা হয়েছে ৯৮ হাজার টাকায়।
সূত্র আরও জানায়, প্রিন্টারের কালির সিডিউল মূর্য ছয় হাজার টাকা। লতিফ প্রতিমাসে ৫০টি কালির বিল করেন তিন লাখ টাকা। অথচ নতুন কালি না কিনে রিফিল করেন ৫০০ টাকায়। অর্থাৎ কালির নামেই প্রতিমাসে দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকা আত্মসাত করেন লতিফ। প্রতিমাসে অন্যান্য স্টেশনারি সামগ্রীর বিল করেন ৪-৫ লাখ টাকা। আর মালামাল কেনা হয় বড়জোর ৭০-৮০ হাজার টাকার। এগুলো পত্রবাহক আজিজুল ইসলামকে দিয়ে কেনান। এ জন্য প্রতিমাসে তাকেও ১৫ হাজার টাকা দেন লতিফ।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৯-২০ সালে টাঙ্গাইলের ঠিকাদার মো. শাহিনের সঙ্গে পার্টনারশীপে ব্যবসা করেন লতিফ। ২০১৫ সালে ৭০ লাখ টাকার ওষুধ না কিনে টাকা আত্মসাতের ঘটনা জানাজানি হলে পুলিশ সদর দপ্তর হাসপাতালের তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্টকে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে বদলি করে। আর আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিফকে টেন্ডার এবং কেনাকাটা কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা দেয়। কিন্তু আরএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে লতিফ আছেন একই দায়িত্বে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে লতিফের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই আগেই চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু চিঠি পড়ে লতিফের হাতেই। তিনি বিষয়টি গোপন রাখেন। সম্প্রতি আরেকটি টেন্ডারে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে গত ৯ আগস্ট একটি নির্দেশনা জারি করে পুলিশ সদর দপ্তর। এতে বিভাগীয় মামলা অথবা বিষয়টি নিস্পত্তি করার জন্য বলা হয়। বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার আবদুস সালামকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়ে
এস/আর