গত ৫ই আগষ্ট গণআন্দোলনের চাপে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তার পদত্যাগের বিষয়টি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। জনরোষের মুখে পরে পুলিশবাহিনী।
শেখ হাসিনা সরকার পুলিশবাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারীদের নির্মমভাবে অত্যাচার ও গুলিবর্ষণ করা ও গত ১৬ বছর থেকে সাধারণ মানুষের উপর এই বাহিনী দিয়ে জুলুম করার কারণে মূলত পুলিশবাহিনীর উপর বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। সারাদেশেই থানা, ফাঁড়ি গুলোতে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালায় ভাঙচুর ও লুটপাট করে। অনেক থানায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়। দুর্বৃত্তরা থানাগুলো থেকে অস্ত্র, বারুদ, গুলি লুটপাট করে নিয়ে যায়। আক্রমণ করা হয় পুলিশ সদস্যদের উপর।
এতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও আত্মগোপনে চলে যায়। ফলে পুলিশ বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে যায়।
জীবন বাঁচাতে থানা গুলো থেকে পালিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। ও মন্ত্রীসভাহীন বাংলাদেশের ‘ল এন্ড অর্ডার পুরোপুরি ব্রেকডাউন হয়ে পড়ে। এই সুযোগে সারাদেহে নজিরবিহীন অরাজকতা, লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সারা দেশই প্রতিহিংসা ও ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে শুরু করে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্থাপমা ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
থানা, ডিবি,ফাঁড়ি গুলো পুলিশহীন হয়ে পড়ায়। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকেই আজ অব্দি দেশের বিভিন্ন জায়গায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, কোনো কোনো জায়গায় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, দোকানপাট লুটপাট শুরু হয়। রাতে নিরাপত্তার অভাবে দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা বাড়িতে ডাকাতি ও চুরির ঘটনা ঘটতে শুরু করে।
এই অবস্থায় পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দরকার ছিল পুলিশ-প্রশাসনের তৎপরতা। কিন্তু মানুষের জানমালের নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব যাদের, সেই পুলিশ-প্রশাসন কোথাও ছিল না ।
বরং, তারা নিজেদের নিরাপত্তাসহ ৯ দফার দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেছেন নন-ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তারা। ক্যাডার কর্মকর্তারাও কোথাও নেই। আর প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরাও অফিসে আসছেন না । ফলে পুলিশ-প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে দেশজুড়ে নিরাপত্তাহীনতায় মানুষ। গতকাল পর্যন্ত দেশের কিছু কিছু থানায় সেনাবাহিনীর সহায়তায় পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ দিলেও সেই স্খ্যং খুব বেশি নয়। সরকারের পতনের পর পুলিশের মধ্যে চলছে ব্যাপক অস্থিরতা। একপক্ষ আরেকপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন। এমনকি কয়েকটি গ্রুপে ভাগও হয়েছেন। সবকটি পুলিশ লাইনসে কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার সদস্যরা বিক্ষোভ করছেন।
আবার কোনো স্থানে সিনিয়র অফিসারদের ওপর চড়াও হচ্ছেন জুনিয়ররা। তবে, অনেকের ধারণা পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্যরা কাজে না ফিরে এইটা জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে তাদের ছাড়া সব কিছু কার্যত অচল। পুলিশ বাহিনীর মধ্যকার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, দাবি দাওয়া, রাগ অভিমানের জন্য সারাদেশ নিরাপত্তাহীনতায় পার করছেন।
এসবের মধ্যে পুলিশহীন বাংলাদেশে ডাকাত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিগত কয়েকদিন থেকেই সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতদের আনাগোনা অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে সংখ্যালঘুদের উপসনালয় ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনা।
ডাকাতদের রুখতে ও সংখ্যালুঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থী, এলাকার সাধারণ মানুষসহ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা রাতভর বিভিন্ন এলাকা পাহারা দিচ্ছে ও পেট্রোলিং করছেন।
ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতদের কিছু দলকে অস্ত্র সহ ধরে সেনাবাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। ডাকাত আতঙ্কে গত ৩ দিন থেকে নির্ঘুম রাত পার করছে দেশবাসী। তবে, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে ডাকাতির প্রকৃত ঘটনা যতটা না বেশি ঘটেছে তারচেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন বিভ্রান্তকর তথ্য প্রচার করে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে বেশি।
কেউ কেউ ডাকাত পরেছে বলে ফেসবুকে পোস্ট করলেও পরবর্তীতে দেখা গেছে আসলে এমন কোনো ঘটনায় ঘটেনি। আবার অনেকে, জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ গুলোতে ডাকাতি ও লুটপাট এর খবর দিয়ে সাহায্যের জন্য পোস্ট করে আবার তা পরে রিমুভ করে দিয়েছেন। এমনও দেখা যাচ্ছে রাতে চোরদের আনাগোনা কে ডাকাত পড়েছে বলে প্রচার করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। সত্য-মিথ্যার মধ্যে আতঙ্কে কয়েকদিন থেকেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে দেশবাসী।
অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী কে বিভিন্ন পেজে ডাকাতি, লুটপাটের পোস্টে বিরূপ মন্তব্য করতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিভিন্ন সমালোচনামূলক পোস্ট করছেন। ফেসবুক ঘেটে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন ফেসবুক একাউন্ট খুলে বা আওয়ামী লীগ কর্মীরা একাউন্ট লক করে বা ডিপি চেঞ্জ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে। একটি দল প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে, ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান থেকে প্রাপ্ত স্বাধীনতা কে কটাক্ষ করে লিখছেন “‘এমন স্বাধীনতাই কী চেয়েছিলাম?”।
অনেকের ধারণা একটি চক্র সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অযুহাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্নভাবে গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও ভয়াবহ রূপ দিতে উঠে পরে লেগেছে। ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে, আইডি ও পেজে প্রায়ই পোস্ট দিয়ে বিভিন্ন এলাকার নাম দিয়ে বলা হচ্ছে “এইসব এলাকায় আজ রাতে ডাকাতি হতে পারে। সবাই সাবধানে থাকবেন”। এখন প্রশ্ন হলো তারা কীভাবে অগ্রীম জানতে পারছেন কোন এলাকায় ডাকাতি হবে? বৃহস্পতিবার রাতে বিভিন্ন আইডি ও পেজ থেকে বলা হয় রাজশাহীর টিকাপাড়া, আলুপট্টি, রেশমপট্টি, শিরইল এলাকায় ডাকাতি হতে পারে! এর ফলে উক্ত এলাকায় উত্তেজনা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এখন এই পোস্ট দাতারা কীভাবে কোন উৎস থেকে এই খবর পাচ্ছেন তা অজানা। এই সব খবরের কোনো সত্যতাও কেউ প্রমাণ করতে পারছে না। অনেকেই ডাকাত এসেছে বলে চিন্তিত হয়ে পোস্ট দিলেও পরবর্তীতে জানাতে পারিনি আদৌ তারা ডাকাত দেখেছে কিনা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিছু ডাকাত দল ধরা পরলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে তারা বিভিন্ন পাড়া মহল্লার ছিচকে চোর বা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এদের স্খ্যংাও ৪ জনের বেশি না। আবার, এরা কেউই প্রফেশনাল ডাকাতদের মতো না। সারাদেশ থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্যানুযায়ী মনে হচ্ছে একটি কুচক্রী মহল কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারীদের ব্যবহার করে দেশে অরাজকতা, সহিংসতা
তৈরির অপচেষ্টা করছে। দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশকে আরো অশান্ত করতে নতুন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে লোক ভাড়া করে নৈরাজ্য, লুটপাট আর ডাকাতির জন্য আ’লীগ নেতারা লোক ভাড়া করছে বলেও জানা যায়। পরিস্থিতি ঘোলাটে করাসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি ছড়াতে রাজধানীতে ডাকাতি করাতে ৩শ’ লোক ভাড়া করে আওয়ামীলীগ নেতারা। পৃথক কয়েকটি বাড়িতে তাদের দিয়ে হানা দেয়ানোর পর ফেসবুকে গণডাকাতির গুজব ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। আ’লীগ এসব নেতার ষড়যন্ত্র ছিলো অশান্ত পরিবেশের কারণে যাতে দেশে কেয়ারটেকার সরকার শপথ নিতে না পারে। একই সাথে সেই সুযোগে দেশে সেনা শাসন আসার সম্ভাবনা তৈরী হবে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিকল্পনায় এসব হচ্ছে বলেও প্রমান মিলছে। সরেজমিনে দেখা যায় যারা গভীর রাতে ডাকাতি বা আতঙ্ক ছড়ানোর কাজ করছে তারা অধিকাংশ বস্তি এলাকার এবং টোকাই তরুণ। সূত্র মোতাবেক তারা টাকার বিনিময়ে ভাড়া খাটছে। রাজধানীর জেনেভা ক্যাম্প এলাকা থেকে এদের কয়েকজনকে ভাড়া করা হয়। বিভিন্ন সূত্র মারফত জানা যায় গত বুধবার মধ্য রাত থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা যেমন- মোহাম্মদপুরের নয়াবাজার, বসিলা, বসিলা কাদিরাবাদ হাউজিং, শেখেরটেক, জিগাতলা, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, শনিরআখড়া, মিরপুরের পল্লবী, মিরপুর ১০, ইসিবি চত্বর এলাকা, উত্তরার ৮-৯, ১০-১১ নম্বর সেক্টর, গাজীপুর ও টঙ্গী কলেজ রোড এলাকায় ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে। কয়েকটি বাড়িতে ডাকাতিও হয়েছে।
এসব ঘটনায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং রাজশাহী মিলে প্রায় ২৯ জনকে আটক করা হয়েছে কিন্তু দুষ্ট চক্র ফেসবুকে প্রচার করছে মহল্লায় মহল্লায় গণডাকাতি হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও বিশৃঙ্খলা করতে মানুষ এর মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য আওয়ামী সন্ত্রাসী ও তাদের বাহিনীর সুপরিকল্পিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে । বিভিন্ন জায়গায় ধৃত দুষ্কৃতিকারিদের আটক করার পর প্রমাণ মিলছে যে আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশেই এসব হচ্ছে। শুধু ডাকাতি নয় গত দুই দিন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী অপহরণের গুজব ফেসবুকে বেশ সরগরম হয়। অপহরণের বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং অনেকেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে কটাক্ষ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে অপহরণের অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা যায় আসলে খবর দুটি মিথ্যা ছিল।
চলমান পরিস্থিতিতে দেশের সর্বত্র অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরিমাণ বেড়েছে তাতে কোনো দ্বিম মত নেই। তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন পোস্ট ও দেশের বিভিন্ন ঘটনা গুলো পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে অরাজকতা ও সহিংসতাকে আরও বেশি বৃদ্ধি করে আতঙ্ক ছড়ানোর কাজে একটি মহল বেশ তৎপর। শুধু দেশে নয় আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতেও বাংলাদেশে গত কয়েকদিনে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের বিষয়টি অতিরঞ্জিত করে এবং বানানো ভুয়া ছবি ও ভিডিও প্রচার করে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
বিএ…