ঢাকাশনিবার , ১৩ জুলাই ২০১৯
আজকের সর্বশেষ সবখবর

সঞ্চয়পত্রে ঝোঁক কমছে, হতাশায় গ্রাহকরা

অনলাইন ভার্সন
জুলাই ১৩, ২০১৯ ৯:২৯ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

খবর২৪ঘণ্টা.কম: সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে ১০ শতাংশ হারে কর কেটে রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর থেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক কিছুটা কমেছে। এতদিন ১ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনে একজন নারী মাসে ৯১২ টাকা মুনাফা পেতেন। এখন পাচ্ছেন ৮৬৪ টাকা। গত মঙ্গলবার জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর এ বিষয়ে নোটিশ দিয়েছে। তাতে স্পষ্ট করে বলেছে,

২০১৯ সালের ১লা জুলাই থেকে নতুন-পুরাতন সকল সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রেই উৎসে কর ১০ শতাংশ কর্তন করা হবে। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।

এ কারণে, অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

এদিকে, বিনিয়োগের নিরাপদ খাত হিসেবে বিবেচিত সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের মাঝে নতুন করে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। গ্রাহকরা জানান, ব্যাংকের প্রতি আস্থা নেই। ফলে সঞ্চয়পত্রই ছিল বিনিয়োগের নিরাপদ মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান সামগ্রিক আর্থিক খাতে চরম অস্থিরতা চলছে। ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সংকট। গ্রাহকদের জমানো আমানত ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এই অবস্থায় আমাদের সঞ্চয়পত্রে করা বিনিয়োগ নিয়েও দু:চিন্তা হচ্ছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সব সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রেই মুনাফার ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত অর্থবছর ৫ শতাংশ হারে ছিল। ১০ শতাংশ আরোপের পর থেকেই গ্রাহকদের মধ্যে এ নিয়ে বিভ্রান্তি শুরু হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হয়। এমনকি জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কিন্তু কমেনি। এদিকে, আগের মুনাফায় ১০ শতাংশ হারে কর কাটা হবে এই আশঙ্কায় অনেকেই ৩০শে জুনের আগেই সঞ্চয়পত্রের টাকা তুলে নেন। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দিন সোমবার থেকে এ নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর দেখা গেল গ্রাহকদের আশঙ্কাই সত্যি হলো। নতুন বা পুরনো সব সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকেই উৎসে কর সমানভাবে কাটা হচ্ছে। শুধু তাই নয় সঞ্চয়পত্রের আগের যেকোন বছরের মুনাফায় ১০ শতাংশ কর দিতে হচ্ছে গ্রাহককে।

এছাড়া সঞ্চয়পত্র কিনতে বেশকিছু শর্তারোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে, সঞ্চয়পত্র কেনার দীর্ঘ লাইন কিছুটা কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় এসেছিলেন আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, পুরনো কয়েকটি ব্যাংকের ওপর নির্ভর করা যায়; কিন্তু ব্যাংকগুলো যে হারে সুদ দেয় ও নিত্যনতুন কেলেঙ্কারি বের হচ্ছে, তাতে মন সায় দিচ্ছে না ব্যাংকে টাকা রাখার বিষয়ে। সেজন্য সঞ্চয়পত্রেই বিনিয়োগ করতে চাই। কিন্তু এখন নতুন করে ভয়ও তৈরি হয়েছে। না জানি এখাতেও ব্যাংকের মতো অবস্থা হয় কিনা। হলে তো মাঠে মারা যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

আগের চেয়ে কম মুনাফা পাওয়ায় নাখোশ অনেকেই। এদেরই একজন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা উম্মে হানি সূচনা বলেন, সঞ্চয়পত্রে আমার বিনিয়োগ ছিল ৭ লাখ টাকা। এতোদিন ১ লাখ টাকায় ৯১২ টাকা অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার এসএমএস আসতো। এখন এসেছে ৮৬৪ টাকা। হঠাৎ করেই এমন করে মাসের আয় কমবে ভাবতে পারিনি। তিনি বলেন, আমার শ্বাশুরির নামেও ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। তারও একই অবস্থা। ফলে সংসারের ও ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়ার খরচ কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি।

গুলিস্তানের জেনারেল পোস্ট অফিসে (জিপিও) কথা হয় রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা সালমা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, আমার ৪ লাখ টাকা মূল্যের পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে ১৬ বছর আগে। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যরা সঞ্চয়পত্রের অংশীদার দাবি করে মামলা করার কারণে এই সময়ে সালমা বেগম এর কোন টাকাই তুলতে পারেননি। দীর্ঘ সময় পর ২০১৯ সালে শুরুতে সেই মামলার রায় সালমা বেগমের পক্ষেই আসে। কিন্তু মামলার রায়

তার পক্ষে এলেও খুশি হতে পারেননি তিনি। কারণ তাকে এখন গুনতে হবে আগের তুলনায় দ্বিগুণ উৎসে কর। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটা কোনোভাবেই মানতে পারছি না। চিন্তা করছি, এই খাতে আর বিনিয়োগই করবো না। সালমা বেগম বলেন, আমাদের মতো অবসরপ্রাপ্ত মানুষের ওপর এটা এক ধরনের জুলুম করা হচ্ছে। এটা আমার শেষ সম্বল। তা পেতেও অনেক হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়েছে আমাকে। আমার টাকা এতদিন সরকারের কাছেই ছিল। তাহলে এই টাকার এত বছরের সুদ না দিয়ে উল্টো দ্বিগুণ কর নিবে কেন?

আরেক গ্রাহক জসিম উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি এখন কর্ম করতে পারি না। বৃদ্ধ বয়সে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর নির্ভরশীল ছিল পরিবার। তার পরও যদি বাড়তি উৎসে করের বোঝা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়- তাহলে সেটা হবে চরম অমানবিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, পুরনো সঞ্চয়পত্রে নতুন উৎসে কর হার ধার্য করা অনৈতিক। কারণ পুরনো সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হলেও সেই অর্থের কোন সুবিধা গ্রাহক ভোগ করেননি। বরং সেই অর্থ সরকারের কাছে ছিল। ফলে, গ্রাহককে অতিরিক্ত সময়ের মুনাফা সুবিধা না দিয়ে দ্বিগুণ উৎসে কর ধার্য করা সম্পূর্ণ অনৈতিক।

তবে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর বলছে, উৎসে কর্তন নিয়মের মধ্যেই হচ্ছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের নোটিশে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১লা জুলাই থেকে নতুন-পুরাতন সকল সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রেই উৎসে কর ১০ শতাংশ কর্তন করা হবে।

সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হানিফ মিয়া বলেন, আমার কথা বাদ দেন। অনেক বিধবা আছে এই মুনাফার উপর ভরসা করে টিকে আছে। এছাড়া আমাদের মতো সামান্য মুনাফা থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর কেটে নেয়া হলে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই সরকারের উচিৎ আমাদের দিকে সুনজর দেয়া।

সঞ্চয়পত্র বিক্রির লাগাম টেনে ধরতেই করের হার বাড়িয়েছে সরকার। ৩০শে জুন শেষ হওয়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৪৩ হাজার ৪৭৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। গত বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ করার লক্ষ্য ধরেছিল। নতুন বাজেটে এই লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা।

এদিকে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সারাদেশে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের নির্দেশনা পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সঞ্চয় অধিদপ্তর এর আগে তিন দফা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, অনলাইন পদ্ধতির বাইরে আর সঞ্চয়পত্রের লেনদেন করা যাবে না। আসল ও মুনাফা ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে চলে যাবে। অনলাইনে সঞ্চয়পত্র কেনার বিষয়ে অর্থ বিভাগ গত ২৯শে মে বাংলাদেশ ব্যাংক, সঞ্চয় অধিদপ্তর, ডাক অধিদপ্তর ও সোনালী ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত মঙ্গলবার সে বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, অগ্রাধিকার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় অর্থ বিভাগ জাতীয় সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করেছে। ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগীয় শহরে এটি চলমান। এতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কোন কথা বলা হয়নি। যদিও অর্থ বিভাগের গত ২৯শে মে’র ভিন্ন এক চিঠিতে দেখা যায়, সব জেলাকে মে এবং সব উপজেলাকে জুন মাসের মধ্যে অনলাইন পদ্ধতিতে সঞ্চয়পত্র কেনাবেচার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

অর্থ বিভাগ এবং সঞ্চয় অধিদফতরের সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছর থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা ও মুনাফা নেয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) এবং ব্যাংক হিসাব থাকা বাধ্যতামূলক। তবে নগদে মাত্র এক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে। সেক্ষেত্রে টিআইএন লাগবে না। এই খাতকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে সরকার এই নিয়ম চালু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে।
বর্তমানে বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বা সুদের হার এখন ১১.০৪ থেকে ১১.৭৬ শতাংশ। অপরদিকে, ব্যাংকে আমানতের গড় সুদহার এখন ৬ শতাংশের ঘরে। কিন্তু মেয়াদি আমানতের সুদহার এর চেয়ে একটু বেশি।সূত্র: মানবজমিন

খবর২৪ঘণ্টা, জেএন

বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।