খবর২৪ঘন্টা নিউজ ডেস্কঃবৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এর দুর্যোগ মুহূর্তেও থেমে নেই প্রতারকরা। এদের মধ্যে ‘জিনের বাদশা’ উত্তরাঞ্চল কেন্দ্রীক প্রতারক চক্রের ছদ্মনাম। ৬টি ধাপে তারা টার্গেট করা ব্যাক্তির কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় লাখ টাকা।
তবে প্রথম ধাপেই যদি এদের রুখে দেয়া যায় তাহলে বাঁচা যায় প্রতারণা থেকে। কিন্তু অনেকেই তা না করে তাদের শিকারে পরিণত হয়। পুলিশের কাছে অভিযোগ করে না। অনেক সময লোকলজ্জার ভয়ে পরিবারের সদস্যদেরও কিছু জানায় না।
সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে বেশ কয়েক বছর ধরে এই চক্রটির উত্থান ঘটলেও এসব কারণেই এখনো টিকে আছে এরা। সাধারণ মানুষের সচেতনতা ছাড়া এদের নির্মূল করা কষ্টসাধ্য। এছাড়া বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) জোরদার মনিটরিং হলে এসব প্রতারককে নির্মূল করা যাবে বলে মনে করেন তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ক্ষেত্রে সবাইকে পরামর্শ দিয়েছে, এসব প্রতারকের প্রলোভন বা ফাঁদে কোনভাবেই পা দেয়া যাবে না। এমন কেউ ফোন করলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানাতে হবে।
পুলিশের ক্রইম ডিভিশন সূত্রে এই চক্র সম্পর্কে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য। সম্প্রতি রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরপিএমপি) হাতে গ্রেফতার প্রতারক চক্রের ৪ সদস্য এসব জানিয়েছে।
জানা যায়, গত ২৭ মে শফিকুল ইসলাম নামে এক সবজি বিক্রেতা রংপুরের মহিগঞ্জ থানায় একটি অভিযোগ করেন। অভিযোগে উল্লেখ্য করেন, গত ৬ মে গভীর রাতে তার মোবাইল ফোনে এক ব্যক্তি ফোন দেয়। শুরুতেই ইসলামিক বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে তার মনে প্রভাব ফেলে। পরে ধাপে ধাপে শফিকুলের কাছ থেকে ১ লাখ আট হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা। অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে আরপিএমপির মহিগঞ্জ জোনের এসি (সহকারী কমিশনার) মো. ফারুখ আহমেদ মাঠে নামেন। পরে গোয়েন্দা তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ২৯ মে ৪ প্রতারককে গ্রেফতার করেন। তারা হলো- রিয়াদ হাসান ওরফে রায়হান, সিদ্দিকুল ইসলাম, আজহার আলী শেখ ও রফিকুল ইসলাম রিপন।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আসামিরা জানায়, টার্গেট ব্যক্তি সংগ্রহের জন্য ‘জিনের বাদশা’ প্রতারক চক্রের সদস্যরা গভীর রাতে নির্জন জায়গা থেকে একটি মোবাইল নম্বরে প্রথমে কল করে। এরপর একাধিক সিম ব্যবহার করে ওই নম্বরে কল করতে থাকে। চক্রটি প্রতিরাতে ওই মোবাইল নম্বরে একাধিক নম্বর থেকে কল করে। কল রিসিভ করলে, শুরুতে সালাম দিয়ে নিজেকে কখনো আল্লাহর ‘ওলী’ হিসেবে যেন হাজির হয়েছেন এমনভাব নিয়ে কথাবার্তার এক পর্যায়ে ‘জিনের বাদশা’ হিসেবে পরিচয় দেয়। এরপর কল রিসিভকারীকে বলে, ‘তুমি খুবই সৌভাগ্যবান, মহান সৃষ্টিকর্তা তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি তোমাকে অঢেল ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা, সোনা-দানা দান করবেন।
যদি তারা বুঝতে পারে, কল রিসিভকারী তাদের কথা বিশ্বাস করছেন না, সঙ্গে সঙ্গে সংযোগটি কেটে দিয়ে নম্বরটি বন্ধ করে দেয় তারা। আর যদি দেখে, কল রিসিভকারী তাদের কথা বিশ্বাস করেছেন, তাহলেই ধাপে ধাপে এগিয়ে চলে প্রতারণার পরবর্তী ধাপ।
প্রথম ধাপে চক্রটির প্রতি ওই ব্যক্তির বিশ্বাস ও আস্থা আরো জোরালো করার জন্য সৎ উপদেশ দেয়। তাদের সঙ্গে ওই ব্যক্তিকে যোগাযোগের বিষয়টি গোপন রাখতেও উদ্বুদ্ধ করা হয়। প্রতারকদের কথায় ওই ব্যক্তি টাকা দেবে কিনা সেটি যাচাই করার জন্য টোপ হিসেবে কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা বা মাজারে কোরআন শরীফ বা জায়নামাজ দেয়ার কথা বলে তাদের দেয়া নম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পাঠাতে বলে। যেসব ব্যক্তি এ টোপটি গিলে টাকা পাঠায় চক্রটি তাদেরকে পরবর্তী টোপ গেলাতে প্রলুব্ধ করে।
দ্বিতীয় ধাপে চক্রটি ওই ব্যক্তিকে মাজারে মুসল্লিদর খাওয়ানোর জন্য একটি খাসি ও ২১ কেজি চালের দাম মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠাতে বলে। এভাবে চক্রটি তার কাছ থেকে ৬/৭ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ধাপেও তাদের সঙ্গে টার্গেট ব্যক্তিকে যোগাযোগের কথা গোপন রাখতে জোর দেয় চক্রটি।
তৃতীয় ধাপে চক্রটি তার কাছে থেকে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদ পাতে। এজন্য চক্রটি তাকে দূরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে ডেকে পাঠায়। সেখানে একা একা যেতে বলা হয়। সেখানে গেলে কাগজ কিংবা কাপড়ে মুড়িয়ে কথিত সোনার পুতুল (আসলে পিতল কিংবা সিমেন্টের তৈরি পুতুল) তাকে দেয়া হয়। সেটি এমনভাবে রাখা হয়, যাতে না খুলে ভেতরে কি আছে- তা বোঝার উপায় থাকে না। পুতুলটি দেয়ার আগেই চক্রটি তাকে বিভিন্ন কথা বলে ভয় দেখায়, পুতুলটি নিয়ে ঘরে ফেরার সময় কাউকে কিছু বলা যাবে না। কোনোভাবেই সেটি খুলে দেখা যাবে না। বাসা বা বাড়িতে নেয়ার তিন দিন পর ‘জিনের বাদশা’ যখন বলবে, কেবল তখন সেটি খুলে দেখা যাবে।
এ নির্দেশ অমান্য করলে তার বিরাট আর্থিক, দৈহিক বা সন্তানের ক্ষতি হবে। এমনকি ঘরে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে তার মৃত্যুও হতে পারে। এতে ভীত হয়ে ওই ব্যক্তি ঘটনাগুলো কারো কাছেই কাছে প্রকাশ করে না। ভেতরে কি আছে সেটি খুলে দেখা থেকে বিরত থাকেন। কথিত সোনার পুতুল হাতে পাওয়ার পর চক্রটিকে জোরালোভাবে বিশ্বাস করতে থাকেন এবং চক্রটির কথা মতো টাকা পাঠাতে থাকেন ওই ব্যক্তি।
চতুর্থ ধাপে, চক্রটি তাকে বলে, তোমাকে সাতটি বড় হাঁড়িতে সোনার মোহর পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে। হাঁড়িগুলো মাটির ৪১ ফুট নিচে রয়েছে। এরমধ্যে একটি হাঁড়ির তলা খুলে গেছে। তলা মরামতের জন্য ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা লাগবে।
পঞ্চম ধাপে, চুক্রটি বলে, তোমার ঘরের চার কোণায় রক্ত দিতে হবে। এজন্য চারটি খাসি বাবদ ৪৩ হাজার ৫০০ টাকা পাঠাও। প্রলোভনে পড়া ব্যক্তি চক্রটির কথা মতো সেই অংকের টাকা পাঠান।
ফাঁদের শেষ ধাপে চক্রটি ভুক্তভোগীকে বলে, ‘তোমার ভয়ানক একটি সমস্যা আছে। সমস্যাটির সমাধান করার জন্য সাতজন নারী (তরুণী) লাগবে। তুমি তো এসব নারীকে সংগ্রহ করতে পারবে না। আমাদের ২৫ হাজার ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দাও। আমরা সব ব্যবস্থা করে নেব। এবারো ভুক্তভোগী ২৫ হাজার ৫০০ টাকা পাঠান।
এভাবে, ধাপে ধাপে লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে সটকে পড়ে প্রতারক চক্রটি। বন্ধ করে দেয় সব সিম। পরবর্তীতে ভুক্তভোগী যখন সোনার পুতুলটি দেখেন তখন বুঝতে পারেন যে, তিনি প্রতারিত হয়েছেন।
আরপিএমপি’র এসি মো. ফারুখ আহমেদ বলেন- প্রথমত জনগণের সচেতনতা প্রয়োজন। পুলিশকে বিষয়টি জানাতে হবে। অপরদিকে বিটিআরসি যদি কঠোর মনিটরং করে তাহলে এ ধারনের প্রতারণাসহ মোবাইল ব্যাংকের প্রতারণার মত বিষয়গুলো রোধ করা সম্ভব। কারণ তদন্তে উঠে এসেছে উদ্ধার পাওয়া সিমগুলোর মধ্যে সবগুলো ভুয়া ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যক্তির নামে। প্রতারকরা মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট ও বিভিন্ন ফোন কোম্পানির সিম বিপণন কর্মীদের যোগসাজসে এসব অপরাধ করছে।
এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কোনোভাবেই প্রলোভনে পড়া যাবে না। জিনের বাদশা নামের প্রতারণার বিষয় পরিবার কিংবা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। এ বিষয়ে তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানান তিনি।খবর২৪ঘন্টা /এবি