খবর২৪ঘন্ট নিউজ ডেস্ক: দেশে রবিবার থেকে সীমিত পরিসরে মার্কেট খুলতে শুরু করেছে। এছাড়া এর আগেই খুলে দেয়া হয়েছে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো। এদিকে একই দিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে রবিবার ২৪ ঘণ্টায় ৮৮৭ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে- যা কি না এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
এর আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন যে, লকডাউন শিথিল করে মার্কেটসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে ধীরে ধীরে মার্কেটসহ অন্যান্য সবকিছু খুলে দিতেই হবে। তবে সেটাও করতে হবে স্বাস্থ্যবিধি বা শর্ত মেনে।
আর তা না হলে আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাংলাদেশে লকডাউন শিথিল করার সময় জনস্বাস্থ্য বিধিগুলো মেনে নেয়া হয়নি।
ফলে তারা ধারণা করছেন যে, এর ফলে সংক্রমণ আরও বেশি দৃষ্টিগোচর হবে। তার মতে, এর ফলে দুই ধরনের ফল আসতে পারে। এক, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হেলদি ক্যারিয়ার বা উপসর্গবিহীন ভাইরাসবাহী হয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াবে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটু কম, বয়স বেশি বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে তাদের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যেতে হবে।
দেশে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং এখন কিউরেটিভ বেজড বা চিকিৎসা নির্ভর মহামারি মোকাবেলার কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে। তিনি মনে করেন, এ ধরনের ব্যবস্থা সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি বয়ে আনবে।
‘মৃতের সংখ্যাও বেড়ে যাবে, ভোগান্তির সংখ্যাও বাড়বে। এটিকে যোগ-বিয়োগ করলে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু করার মধ্য দিয়ে যতটা লাভবান হওয়ার কথা ভাবছি, স্বাস্থ্য খাতে খরচ এবং ভার বেড়ে যাওয়ার কারণে তা না হয়ে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। কারণ মানুষ যদি অসুস্থ হয় তাহলে সরকারের সাথে সাথে পরিবারের অর্থনীতিতেও খরচ বেড়ে যাবে।’ বলেন তিনি।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার কী অবস্থা?
সরকার বলছে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সবধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন ভাইরাসটির প্রবেশ ঠেকাতে এবং সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখনো পর্যন্ত যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা ‘সন্তোষজনক’ নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পুরো দেশে আইসোলেশন শয্যার সংখ্যা ৮৬৩৪টি। এছাড়া আইসিইউ ৩২৯টি এবং ডায়ালাইসিসের সংখ্যা ১০২টি রয়েছে বলেও নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
তবে সবগুলো আইসিইউতে ভেন্টিলটরসহ সকল ব্যবস্থা আছে কি না তা নিশ্চিত নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, পুরো দেশে ৩০টির বেশি ল্যাবে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশে আইসিসিবি- ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার চারটি কনভেনশন সেন্টার এবং একটি প্রদর্শনী তাঁবুতে গড়ে উঠছে দেশের সবেচেয়ে বড় কোভিড-১৯ হাসপাতাল। এখানে দুই হাজার ১৩টি শয্যা পাতা হয়েছে। এছাড়া রোগীদের আইসোলেশন করে রাখা এবং পোর্টেবল অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
তবে লকডাউনের শর্ত শিথিল করার কারণে সংক্রমণ বেড়ে গেলে তা মোকাবেলায় কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ডা নাসিমা সুলতানা বলেন, যখন যে ব্যবস্থা দরকার হবে তখন সে ব্যবস্থাই নেয়া হবে। তিনি বলেন, ‘পদক্ষেপ যা নেয়া হচ্ছে তা দৃশ্যমান এবং এই প্রক্রিয়া চলমান।’
এছাড়া রবিবার তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার অনুমতি দেয়া হয়েছে, প্রতিদিন পরীক্ষার জন্য ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে, বসুন্ধরায় বড় একটি হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে এগুলোও একেকটা পদক্ষেপ এবং এগুলো চলমান। সিচুয়েশন যেটা ডিমান্ড করবে সরকার সেটাই করবে।
তিনি বলেন, সরকার তো খুব বেশি অর্থশালী নয়। যার কারণে আগে থেকেই ১৮ কোটি মানুষের জন্য হাসপাতাল তৈরি করা যাবে না।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই দেশে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মাত্র দেড় লাখ হাসপাতাল শয্যা রয়েছে বলে জানান ডা. নাসিমা সুলতানা।
লকডাউন শিথিল করার কারণে নতুন কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এর জন্যই তো নতুন হাসপাতাল হলো, দরকার হলে আরো হবে।’
সামনের অবস্থা কি সামলানো যাবে?
সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে গেলে বর্তমান স্বাস্থ্য সুবিধা দিয়ে তা সামাল দেয়া সম্ভব কি না তা নিয়ে আলাদা মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকে বলছেন যে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। আবার অনেকে বলছেন যে, বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহার করা গেলে এটি দিয়েই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সামাল দেয়া সম্ভব।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দেশে সামনের দিনগুলোতে করোনাভাইরাসের রোগীর সংখ্যা বাড়লে তা সামাল দেয়া যাবে কি না তা বুঝতে হলে বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে হবে।
এ বিষয়ে তিনি সম্প্রতি মারা যাওয়া এক সচিবের উদাহরণ টেনে বলেন, একজন অতিরিক্ত সচিব হাসপাতাল হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে না পেরে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু আইসিইউ সেবা না পেয়ে তার মৃত্যু হয়।
শনিবার দুপুরে একজন অতিরিক্ত সচিব কিডনি জটিলতায় অসুস্থ হয়ে পড়লে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করার পর মারা যান। তার মেয়ে অভিযোগ করেন, কোভিড-১৯ এর কোন উপসর্গ না থাকলেও বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও তার বাবাকে ভর্তি করাতে পারেননি। পরে বাধ্য হয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
লেলিন চৌধুরী বলেন, এর থেকে এটাই বোঝা যায় যে, এখন যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আছে তা বর্তমান চ্যালেঞ্জকেই সামাল দিতে পারছে না। সামনে যদি হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বেড়ে যায়, তাহলে চিকিৎসা স্বাস্থ্য সেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে।
তবে এর থেকে ভিন্ন মত দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ। তিনি মনে করেন, দেশের বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থাই যদি পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে হয়তো সামনের দিনগুলোতে রোগীর চাপ সামাল দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, মানুষকে কীভাবে পুরো চিকিৎসা দেয়া হবে তার একটা পরিকল্পনা করতে হবে।
কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে নন কোভিড রোগীরাও যাতে বাদ না পড়েন সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে বর্তমানে বেসরকারি চিকিৎসা খাত ইনঅ্যাকটিভ বা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। এটাকে অ্যাকটিভ বা সক্রিয় করা হলে চিকিৎসা সক্ষমতা বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
‘সরকারি ব্যবস্থা থেকে যদি মানুষ ২০% স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে থাকে তাহলে প্রাইভেট সেক্টর থেকে ৮০% নেয়।’
এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে যাতে কেউ সংক্রমিত হয়ে না পড়ে সে বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি মনে করেন, শুধু রাজধানী ঢাকা নয় বরং দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও যাতে কোভিড রোগীরা সেবা পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এর উপায় হিসেবে ৪৯১টি উপজেলায় কোভিড রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে বলে মত দেন তিনি। সূত্র: বিবিসি বাংলা
খবর২৪ঘন্টা/নই