নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী মহানগরীর ঘোষপাড়া মোড়ের একটি পুকুর অবৈধভাবে ভরাট করার অভিযোগ উঠেছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। নগরীতে জলাশয় ভরাট বন্ধে উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও থামানো যাচ্ছে না এই অনিয়ম। এতে দিনে দিনে রাজশাহী নগরী জলাশয় শূন্য হয়ে পড়ছে, যা পরিবেশ ও নগরীর ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও সামাজিক বাধা উপেক্ষা করে পুকুর ভরাটকারীরা নগরীর পরিবেশকে বিপর্যস্ত করছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫(১) ধারা অনুযায়ী, কোনো জলাধারের শ্রেণি পরিবর্তন বা তা ভরাট করা নিষিদ্ধ। এছাড়া, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর অধীনে জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ।
রাজশাহী মহানগরীতে একসময় প্রায় ২,৫০০ পুকুর ও ডোবা ছিল, কিন্তু গত কয়েক বছরে ব্যাপকভাবে পুকুর ভরাটের কারণে বর্তমানে মাত্র ৫০০ পুকুর ও ডোবা অবশিষ্ট রয়েছে। ২০১৪ সালে নগরীতে প্রায় ১,০০০ পুকুর ছিল, তবে পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে ভরাটের কারণে এই সংখ্যা দ্রুত কমে গেছে, যা নগরীর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২০ সালে উচ্চ আদালত এক রায়ে দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুরগুলোকে “প্রাকৃতিক জলাধার” হিসেবে ঘোষণা করে এবং এগুলো সংরক্ষণে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন। তবে বাস্তবে এই নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না।
ঘোষপাড়া মোড়ের অবৈধভাবে পুকুর ভরাটের এই ঘটনায় মহল্লাবাসী ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পুকুর ভরাট বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, প্রভাবশালীরা প্রথমে পুকুর ভরাট করে, এরপর সেটিকে প্লট আকারে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে নগরীতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর হেতেমখাঁ এলাকার এক ব্যক্তি জানান, প্রভাবশালীরা প্রভাব খাটিয়ে ভেকুমেশিন ঠিকাদারের মাধ্যমে পুকুর ভরাট করছেন। প্রশাসনের বাধা এলে কিছুদিন কাজ বন্ধ রাখে, পরে আবার শুরু করে। ইতিমধ্যে পুকুরের কিছু অংশ বিক্রি হয়ে গেছে এবং সেখানে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। যারা কিনেছে তারা চার পাশে ভরাটের কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ভরাটের কাজ অর্ধেক কমপ্লিট করে একটা রেস্টুরেন্টও হয়েছে পুকুরের একটি কোনায়।
এই বিষয়ে ভেকুমেশিন ঠিকাদাররের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও পাওয়া যায়নি।
উক্ত পুকুর ভরাট বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “জনগণ বা পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযোগ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেনি।”
পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহীর সহকারী পরিচালক মোঃ কবির হোসেন জানান, “পুকুর ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে লিখিত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, আর ভরাট করবেন না।”
রাজশাহী জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার বলেন, “এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জলাশয় ভরাটে সরকারি নিষেধাজ্ঞা স্বত্তেও অবৈধভাবে পুকুর ভরাটের ঘটনায় নগরবাসী প্রশাসনের নীরব ভূমিকা পালনের জন্য ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
রাজশাহী মহানগরীর বাসিন্দা আরিফ বলেন,”নগরীতে জলাবদ্ধতা দিন দিন বাড়ছে। আগে রাজশাহীতে অনেকগুলো পুকুর ছিল অথচ এখন হাতে গোনা কয়েকটি পুকুর অবশিষ্ট আছে। এই পুকুরগুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্পদ, অথচ রাতের অন্ধকারে এগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। প্রশাসন কিছুই করছে না”।
ঘোষপাড়া এলাকার বাসিন্দা রনি বলেন,”আমাদের এলাকায় প্রতিটি বর্ষায় জলাবদ্ধতা হয়, কারণ আশেপাশের সব জলাশয় ভরাট করে বহুতল ভবন বানানো হয়েছে। পুকুর যদি এইভাবে ভরাট হয়ে যায়, তাহলে সামনের বর্ষায় আমাদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।”
এইদিকে পরিবেশবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, একটি শহরের অন্তত ৫-১০% জায়গা জলাশয় হিসেবে সংরক্ষণ করা উচিত। কিন্তু রাজশাহী মহানগরীতে জলাশয়ের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে, যা পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
মহানগরীর জলাশয় গুলো সংরক্ষণের বিষয়ে পরিবেশবিদরা প্রশাসনকে কতগুলো পদক্ষেপ যেমন- অবৈধভাবে পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কার্যকর করতে প্রশাসনকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে স্থানীয়দের আইনি সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া, নগর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জলাধার সংরক্ষণ নিশ্চিত করনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন।
পরিবেশবিদরা বলছেন, যদি এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে রাজশাহী আগামী কয়েক কয়েক বছরের মধ্যে জলাবদ্ধতার মারাত্মক সমস্যায় পড়বে নগরবাসী। শহরের তাপমাত্রা বাড়বে,জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হবে এবং বাসযোগ্যতা কমে যাবে।
বিএ..