নজরুল ইসলাম জুলু : রাজশাহী পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার নানা অভিযোগ করে আসছে স্থানীয় সেবাগ্রহীতারা। পাসপোর্ট সেবা গ্রহণকারীদের অভিযোগ রাজশাহী পাসপোর্ট অফিস দালাল চক্রের আখড়া ও এইখানে ঘুষ বিনিময় ছাড়া কোনো কাজ হয়না।
রাজশাহী পাসপোর্ট অফিসের নানান অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির প্রতিবাদে গত ২০ নভেম্বর ভুক্তভোগীরা নগরীর শালবাগান বাজারে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনে মানববন্ধন করেন। পরে ভুক্তভোগীরা এ ব্যাপারে রাজশাহী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক (ডিডি) রোজী খন্দকারের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর কক্ষে যান। এ সময় তাঁর সঙ্গে ভুক্তভোগীদের উচ্চবাচ্য হয়। এর জেরে থানায় অভিযোগ করেন ডিডি রোজী খন্দকার।
এ ঘটনার পর সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের টনক নড়ে এবং শুরু হয় বিভাগীয় তদন্ত। তদন্ত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাজশাহী সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে তদন্ত কমিটির প্রধান ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক মঈনুল হোসেন ভুক্তভোগীদের অভিযোগ শোনেন। এই সময় ১৫/১৬ জন ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতাদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়।
ভুক্তভোগীরা রাজশাহী আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে তাদেরকে জিম্মি করে ঘুষ আদায় করা, নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, হয়রানি, দালালদের দৌরাত্ম্য , অব্যবস্থাপনা সহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ করেন ও প্রমাণ তুলে ধরেন । এসময় ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগও গ্রহণ করা হয়। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য লিখে নেন সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর নাজমুল হোসেন।
এ সময় একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, তাকে একটি পাসপোর্টের জন্য ২০হাজার টাকা ঘুষ প্রদান করতে হয়েছিল। আর একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, রাজশাহী পাসপোর্ট অফিসে সব সমস্যার সমাধান দেন আনসার সদস্যরা। এখানে দালালের মাধ্যমে ঘুষ দিলে লাইন লাইনের মতো থাকে, ঘুষ দেওয়া ব্যক্তির কাজ সবার আগে হয়ে যায়। তার দাবি, পাসপোর্ট অফিসে ৯৮ ভাগ মানুষকে ঘুষ দিয়ে কাজ করতে হয়। কমিটির কাছে একজন নারী জানান, কয়েক মাস আগে তিনি পাসপোর্ট করতে যান। শুরুতেই তার ফরমের ভুল ধরে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি তখন ডিডি রোজী খন্দকারের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু তিনি কোনো সমাধান দেননি। বাধ্য হয়ে তিনি একটি মাধ্যমে দুই হাজার টাকা ঘুষ দেন। এরপর ওই ব্যক্তি তাকে সরাসরি ছবি তোলার কক্ষে পাঠিয়ে দেন। তখন ওই আগের ফরমেই তার কাজ হয়ে যায়।
রাজশাহী মহানগর বিএনপির একজন নেতার ভাতিজা তদন্ত কমিটিকে বলেন, তাঁর চাচার নামে মামলা আছে। পাসপোর্টের আবেদন করার সময় আদালতের অনুমতিপত্রও জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরেও তিন মাস ধরে ফাইল আটকে রাখেন ডিডি রোজী খন্দকার। তখন তিনি একটি মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দেন। এর ১৫ দিনের মধ্যে তাঁর চাচার পাসপোর্ট হয়ে যায়।
একজন ফার্মেসী মালিক তদন্ত কমিটিকে জানান, কয়েকমাস আগে তিনি নিজেই অনলাইনে পাসপোর্টের ফরম পূরণ করেছিলেন। তখন একটি ভুল হয়েছিল। এই ভুলটি ঠিক করতে হলে ডিডি রোজী খন্দকারকেই প্রয়োজন। তিনি একটি আবেদন গ্রহণ করে একদিনেই এটি ঠিক করে দেওয়ার কথা। কিন্তু রোজী খন্দকার সাতদিনেও এটি করে দেননি। তখন তিনিও একটি মাধ্যমে দুই হাজার টাকা ঘুষ দেন। এরপর তার সংশোধন হয়।
তদন্ত কমিটির কাছে অনেকেই অভিযোগ করেন, ডিডি রোজী খন্দকার সেবাগ্রহীতাদের তার কক্ষে ঢোকার অনুমতি দিতে চান না। দীর্ঘ সময় পর কক্ষে ঢোকার অনুমতি মিললেও ভেতরে বসার সুযোগ থাকে না। অসুস্থ রোগী থেকে শুরু করে সবাইকে ডিডির টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে হয়। আর ডিডি চেয়ার-টেবিলে বসে থাকেন। এভাবে তিনি নাগরিকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকেন। সরকারি অফিসে এটা হতে পারে না।
ক্যাবের রাজশাহীর একজন নেতা পাসপোর্ট অফিসের ডিডি রোজী খন্দকারকে ফ্যাসিবাদের দোসর উল্লেখ করে তদন্ত কমিটিকে বলেন, সরকার সারা দেশে ডেভিল হান্ট পরিচালনা করে শয়তান ধরছে। পাসপোর্ট অফিসের ডিডিকেও আইনের আওতায় আনা দরকার। তাঁকে শুধু চাকরিচ্যুত করলে হবে না, গ্রেপ্তার করতে হবে।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের পরিচালক একেএম মাজহারুল ইসলাম বলেন, ভুক্তভোগীদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তারা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে অধিদফতরে জমা দেবেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে রাজশাহী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক (ডিডি) রোজী খন্দকারকে ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ না করায় তার কোনো বক্তব্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি।
বিএ..