বিশেষ প্রতিবেদক :
মাইক্রোবাসের উপরে শুধু লোক দেখানো সাইরেন লাগিয়ে এ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আখ্যায়িত করে রোগীদের সাথে প্রতারণা করে আসছে একশ্রেণীর অসাধু মাইক্রোবাস মালিক ও চালকরা। এতে করে নিত্যদিন প্রতারণার শিকার হচ্ছে দূর-দুরান্ত থেকে রাজশাহীতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। প্রতিনিয়তই ঘটছে এমন ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে একশ্রেণীর মাইক্রোবাস মালিক ও কিছু অসাধু চালক বেশি টাকা ভাড়া আদায়ের জন্য এ কৌশল অবলম্বন করে রোগীদের সাথে প্রতারণা করছে। এরপরও তারা আইনের আওতায় আসছে না। চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা
প্রতারিত হলেও ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না। কারণ অধিকাংশ মাইক্রোবাস চালক রাজশাহী মহানগরীর স্থানীয় হওয়ায় তারা প্রভাব খাটিয়ে রোগীদের সাথে এমন প্রতারণা করে। গাড়ীতে রোগী তোলার আগে এ্যাম্বুলেন্স বলে তোলা হলেও পরে এ্যাম্বুলেন্সে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকে তার কিছুই পাওয়া যায়না সেই মাইক্রোবাসে। শুধু প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে মাইক্রোবাসের উপরে লাগানো রয়েছে সাইরেন। যেটা দিয়ে তারা নিজেদের রাস্তা ক্লিয়ার করে ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনায়াসে চলাচল করতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালকে কেন্দ্র করে প্রায় শতাধিকেরও বেশি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অধিকাংশই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম-কানুন মেনে তৈরি হয়নি। রামেক হাসপাতাল ও রাজশাহীর লক্ষীপুরে অবস্থিত বেশ কয়েকটি বড় ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে চিকিৎসা নিতে আসে রোগীরা। বাইরে থেকে নিতে এসে ফিরে যাওয়ার সময় বা উন্নত চিকিৎসা নিতে ঢাকা যাওয়ার জন্য যখন তারা এ্যাম্বুলেন্স খোঁজেন এসব মাইক্রোবাসে সাইরেন লাগানো এ্যাম্বুলেন্স এর দালালরা রোগীদের সাথে
যোগাযোগ করে ভাড়া ঠিক করে। গাড়ীতে উঠার পরে রোগীরা জানতে পারে সেটি এ্যাম্বুলেন্স নয়। এভাবে প্রায় রোগীরা দালাল চক্র ও অসাধু চালকদের কাছে প্রতারিত হয়ে আসছেন। তারা শুধু মাত্র নিজেদের মাইক্রোবাস জিপকে সাইরেন লাগিয়ে আলাদা রুট পারমিট ছাড়া রাস্তায় নামিয়ে দিচ্ছেন। অথচ রোগীর সুরক্ষার জন্য একটি এ্যাম্বুলেন্সে প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকা জরুরী। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত এটি মিনি হাসপাতালের ভ‚মিকা পালন করে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, একটি এ্যাম্বুলেন্সে ভেনটিলেটর, অক্সিজেন, কার্ডিয়াক মনিটর, ইমার্জেন্সি ড্রাগসহ অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী উপকরণসহ আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার
ইউনিট) থাকা জরুরী। কিন্তু দেশের কিছু এ্যাম্বুলেন্সে এসব সুবিধা থাকলেও বেশিরভাগ এ্যাম্বুলেন্সেই নেই। এসব সুবিধা না থাকলে তাকে এ্যাম্বুলেন্স বলা যাবে না। তারা আরো বলছেন, এ্যাম্বুলেন্স কখনও প্রাইভেট কার বা যাত্রীবাহী গাড়ি হতে পারে না। এ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে রোগীর একটা যোগসূত্র রয়েছে। চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত রোগীকে সাময়িক কিছু চিকিৎসা সেবা দেওয়ার দায়িত্বও এ্যাম্বুলেন্সের ওপর বর্তায়। আর এ্যাম্বুলেন্স মানে শুধু সুন্দর গাড়ি (কার) হলেই চলবে না। এখানে থাকবে আইসিইউর প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসা উপকরণ। প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধও থাকতে হবে। আর এসব সুবিধা থাকলেই একজন মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে আনার সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। দেশে জরুরী চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েই
এখন পর্যন্ত কোন নীতিমালা নেই। আর এটা না থাকায় এ্যাম্বুলেন্স পরিচালনায় কোন নীতিমালা হচ্ছে না। এ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে টাকাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এ সুযোগে এখন রেন্ট এ কারের মতোই এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা চলছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগ ও আশেপাশের এলাকায় অনেক এমন লোক দেখানো এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকা। তারপরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রামেক হাসপাতালে খালুকে চিকিৎসা করতে নিয়ে আসা আব্দুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, আমরা রামেক হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম। কয়েকদিন চিকিৎসা শেষে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক
উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে যেতে বলেন। ঢাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য এ্যাম্বুলেন্স খুঁজলে একব্যক্তি তাদের এ্যাম্বুলেন্স বলে একটি সাইরেন লাগানো মাইক্রোতে উঠিয়ে নেয়। এ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ভাড়াও ধরে। কিন্ত সেই গাড়ীতে এ্যাম্বুলেন্সের কোন সুযোগ-সুবিধা ছিল না। সুবিধা না থাকায় রোগী নিয়ে বিপাকে পড়েছিলাম। অনেক কষ্টে ঢাকায় পৌঁছেছিলাম। তাই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। জহির নামের আরেক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, এখানে কিছু কিছু চালক আছে যারা রোগীদের বাঁচা মরার দিকে না দেখে টাকার দিকে দেখে। এ কারণে রোগীদের সাথে কিছু বেশি টাকার জন্য প্রতারণা করেন। এর বিচার করা উচিত। এভাবে অনেক রোগী ও তাদের স্বজনদের পক্ষ
থেকেই অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যেকেই এ ধরণের চালক বেশধারী দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। শুধু রাজশাহী মহানগরই নয় আশেপাশের জেলা ও উপজেলাগুলোতেও এমন চিত্র রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে রাজশাহীর ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. রোজিয়ারা খাতুন বলেন, একটি এ্যাম্বুলেন্সে ভেনটিলেটর, অক্সিজেন,
কার্ডিয়াক মনিটর, ইমার্জেন্সি ড্রাগসহ অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী উপকরণ থাকা জরুরী। শুধু সাইরেন থাকলেই চলবেনা। কেউ যদি মাইক্রোবাসকে এ্যাম্বুলেন্স হিসেবে শুধু সাইরেন লাগিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করে তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। মাইক্রোবাসে সাইরেন লাগিয়ে এ্যাম্বুলেন্স হিসেবে চালানোর কোন সুযোগ নেই।
আর/এস
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পুর্ণ বেআইনি।