নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী মহানগর বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। দলীয় শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে কেন্দ্রীয় কমিটির তিন নেতাকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে, যা মহানগর বিএনপির দুর্বল নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলাকে আরও উন্মোচন করেছে। এইদিকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির তিন নেতাকে সতর্কবার্তা পাঠানোর পরই অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এতে মহানগর বিএনপির নেতৃত্বের দুর্বলতা ও বিভক্তি আবারও স্পষ্ট হয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে—বিএনপির সাংগঠনিক নীতিমালা অনুযায়ী মহানগর আহ্বায়ক কমিটির নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের সতর্কবার্তা বা কোনো বহিষ্কারাদেশ দেওয়ার কী আদৌ কোনো ক্ষমতা রাখেন কিনা তা নিয়ে।
সতর্কবার্তা পাঠানো কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা হলেন—বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, বিএনপির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এবং বিএনপির ত্রাণ পুনর্বাসন সহ-সম্পাদক শফিকুল হক মিলন।
*কেন এই সতর্কবার্তা?*
গত ১৮ মার্চ (মঙ্গলবার) রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী এশা, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদা ও সদস্য সচিব মামুন অর রশিদ স্বাক্ষরিত পৃথক চিঠির মাধ্যমে এই সতর্কবার্তা পাঠানো হয়।
চিঠিতে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মহানগর বিএনপির অনুমোদন ছাড়া তিন নেতা বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করেছেন। দলীয় ব্যানার ব্যবহার করে সংগঠনের গঠনতন্ত্রবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগও আনা হয়েছে।
বিশেষ করে শফিকুল হক মিলনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি মহানগর বিএনপির সঙ্গে কোনো সমন্বয় ছাড়াই বিভিন্ন সাংগঠনিক পদ ঘোষণা করেছেন এবং দলীয় শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করেছেন।
অন্যদিকে, মিজানুর রহমান মিনু ও মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মহানগর বিএনপির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন, যা মহানগর কমিটির ঐক্য বিনষ্ট করছে।
*মহানগর বিএনপির ব্যাখ্যা*
রাজশাহী মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মামুন অর রশিদ জানান, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কেন্দ্রের নির্দেশেই এই সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে আব্দুস সালামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু অভিযুক্ত নেতারা বারবার একই কাজ করায় বাধ্য হয়ে তাদের সতর্ক করা হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, মিজানুর রহমান মিনু আগে দলের এক নেতার বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ তুলেছিলেন, যা পরে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। এই ধরনের মনগড়া অভিযোগ ও শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণেই তাদের সতর্ক করা হয়েছে।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট এরশাদ আলী এশা অভিযোগ করে বলেন, ২০২১ সালে মহানগর কমিটি গঠনের পর থেকেই এই তিন নেতা বিভিন্নভাবে কমিটির কার্যক্রমে অসহযোগিতা করছেন। ফলে মহানগর বিএনপি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে আলাদা কর্মসূচি পালন করছে। এতে দলীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রের নির্দেশেই এই চিঠি পাঠিয়েছি। তারা চাইলেও মানতে পারেন, না মানলেও আমরা বিষয়টি কেন্দ্রকে জানাবো। তারপর কেন্দ্রই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’
কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া: চিঠির বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন :
সতর্কবার্তার পর মিনু ও বুলবুল সরাসরি এরশাদ আলী এশাদের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেছেন,‘কোনো ইউনিট কমিটির কি ক্ষমতা আছে কেন্দ্রীয় নেতাদের সতর্ক করার? মহানগর বিএনপি নিজেদের মগের মুল্লুক বানিয়ে ফেলেছে।’
মিনু বলেন, ‘আমরা তারেক রহমানের নির্দেশে কাজ করি। মহানগর বিএনপির কোনো অধিকার নেই আমাদের সতর্ক করার। তিনি বলেন সতর্কবার্তা প্রদান বা বহিষ্কার আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন জনাব তারেক রহমান ও মহাসচিব জনাব মির্জা ফখরুল ইসলাম ফোবিয়ার আলমগীর সাহেবের রয়েছে।’
*মহানগর বিএনপির ব্যর্থতা ও নীতিমালার লঙ্ঘন*
এই ঘটনাটি বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী গুরুতর প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। বিএনপির দলীয় নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো মহানগর বা জেলা কমিটির অধিকার নেই কেন্দ্রীয় নেতাদের সতর্ক করার।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা ও লঙ্ঘনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মধ্যে সীমাবদ্ধ। গঠনতন্ত্রের ৫(গ) ধারা মোতাবেক, দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে লিপ্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তবে, মহানগর আহ্বায়ক কমিটির কেন্দ্রীয় নেতাদের সতর্কবার্তা বা বহিষ্কার করার ক্ষমতা নেই; এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেবল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মধ্যে সীমাবদ্ধ।
এ অবস্থায় মহানগর বিএনপির এই চিঠি কেবল দলীয় বিভক্তিরই প্রমাণ দেয় না, বরং এটি দলীয় নীতিমালার চরম লঙ্ঘনও। এই ঘটনার পর অনেকেরই প্রশ্ন মহানগর বিএনপি কি এখন নিজেদের ‘স্বাধীন ইউনিট’ হিসেবে চালাতে চায়, যেখানে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও অবজ্ঞা করা হয়?
রাজশাহী মহানগর বিএনপি বারবার নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে মহানগর কমিটি গঠনের পর থেকেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলে আসছে। ফলে মহানগর বিএনপি কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আলাদা কর্মসূচি পালন করছে।
নেতৃত্বহীনতা ও ভুল সিদ্ধান্তে দুর্বল মহানগর বিএনপি:
রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দলীয় নীতিমালার পরিপন্থী এবং সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিকর। গঠনতন্ত্রের ৫(গ) ধারা স্পষ্টভাবে বলছে যে, দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেবল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির রয়েছে। কিন্তু মহানগর বিএনপি সেই নীতিমালা উপেক্ষা করে নিজেই কেন্দ্রীয় নেতাদের সতর্ক করছে, যা সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত দেয়।
এই ধরনের কর্মকাণ্ড দলের ভেতরে বিভাজন বাড়িয়ে তুলবে এবং রাজশাহী মহানগর বিএনপির অবস্থান আরও দুর্বল করবে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি দ্রুত হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দলের বৃহত্তর রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এই ঘটনায় স্পষ্ট, রাজশাহী মহানগর বিএনপি নেতৃত্বহীনতার শিকার। নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে গিয়ে তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেই অবজ্ঞা করছে, যা দলীয় শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এখন দেখার বিষয়, কেন্দ্রীয় কমিটি এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয় এবং রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা কীভাবে সামাল দেওয়া হয়।
বিএ..