বিশেষ প্রতিনিধি: রাজশাহী মহানগরীতে জাল স্বাক্ষরে আদালতের অনুমতি বা আদালতকে না জানিয়েই প্রতিবন্ধীর জমি জাল স্বাক্ষরে কিনে তা দখলের পায়তারার অভিযোগ উঠেছে একটি প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে। শুধু জমি কিনেই তারা ক্ষ্যান্ত হননি জমিটি দখলের জন্য হামলাও করা হয়েছে বলে থানায় অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী পরিবার। ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা সেই জমি রক্ষার জন্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ নিয়ে প্রতিবন্ধীর পরিবারের পক্ষ থেকে তার ভাই গোলাম হাফিজ মুছা রাজপাড়া থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। আদালতে মামলা, থানায় অভিযোগ ও থানায় সাধারণ ডায়েরি রয়েছে প্রতিবন্ধী হোসনে মাহাবুবুন আক্তার চুনির ভাই গোলাম হাফিজ মুছার পক্ষ থেকে। প্রতিবন্ধী হিসেবে চুনি নিয়মিত সরকারী ভাতা পান।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, নগরীর রাজপাড়া থানার কাজিহাটা এলাকার মৃত গোলাম হায়দারের প্রতিবন্ধী মেয়ে হোসনে মাহাবুবুন আক্তার চুনির নামে কাজিহাটা মৌজায় ০.০৪৯৬ একর অর্থ্যাৎ ৩ কাঠা জমি রয়েছে। সেই জমিতে একটি টিনসেড বাড়ি আছে। তার বাড়ির পাশে রজব আলী (৫৫) এর বাড়ি। পাশপাশি বাড়ি হওয়ার সুবাদে চুনি সেই বাড়িতে যাতায়াত করেন। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গত ১ বছর আগে রজব আলী নাটোর জেলার লালপুর থানার পুরাতন ঈশ্বরদি গ্রামের শওকত আলীর ছেলে ব্যাংক কর্মকর্তা শফিকুরের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে কম টাকায় জমিটি তার
নামে জাল স্বাক্ষরে রেজিস্ট্রি করে দেন। ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারী জমিটি প্রতিবন্ধীর কাছ থেকে রেজিস্ট্রি করে কিনে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্ত প্রতিবন্ধী ভাতা তোলার স্বাক্ষর ও জমির দলিলের স্বাক্ষরে মিল পাওয়া যায়নি। নামের বানানেও অসঙ্গতি দেখা গেছে। জমির দলিল অনুযায়ী দাম ধরা হয়েছিল ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। অভিযোগে বলা হয়, সেই জমির দাম ৩৫ লাখ টাকা কাঠা। নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা কাজিহাটার জমির দাম এত কম নয়।
সরকারী নিয়ম অনুযায়ী কোন প্রতিবন্ধীর জমি কিনতে হলে আদালতের অনুমতি নেয়ার নিয়ম রয়েছে। অনুমতি নেওয়ার পর সেই প্রতিবন্ধীর ভাই-বোন বা অন্য কোন অভিভাবকের মাধ্যমে কিনতে হবে। কিন্ত এ জমি কেনার ক্ষেত্রে সেটি মানা হয়নি। উল্টো জমি ক্রেতা শফিকুর রহমান দাবি করেন, তিনি কোন প্রতিবন্ধীর কাছ থেকে জমি কেনেননি, তিনি সুস্থ মানুষের কাছ থেকে জমি কিনেছেন। কিন্ত ওই প্রতিবন্ধীর ভাই গোলাম হাফিজ মুছার পক্ষ থেকে নগরীর রাজপাড়া থানায় দেয়া অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়েছে, হোসনে মাহাবুবুন আক্তার চুনি পাগল। পুলিশ রিপোর্ট ছাড়াও সরকারের সমাজসেবা অধিদফতরের পক্ষ থেকে দেয়া পরিচয়পত্রে তাকে শ্রবণ প্রতিবন্ধীতা ও মাঝারি প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এ ধরণের একজন প্রতিবন্ধীর কাছ থেকে জমি কিনতে হলে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। কিন্ত এক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি। এখন জমিটি দখলের পায়তারা করছে প্রভাবশালীরা।
প্রতিবন্ধী নারীর ভাই গোলাম হাফিজ মুছা অভিযোগ করে জানান, তার প্রতিবেশী রজব আলীর বাড়িতে তার ছোট বোন চুনি যাতায়াত করতো। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রজব আলী হয়তো শফিকুরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জাল দলিল ও স্বাক্ষর বানিয়ে বোনের জমি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। বিষয়টি তারা জানার পরে তিনি ২০২০ সালের ১ এপ্রিল রাজপাড়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। সেখানে উল্লেখ করেন, তার প্রতিবন্ধী ছোট বোন হোসনে মাহাবুবুন আক্তার চুনির নামীয় ৩ কাঠা জমি ফুঁসলিয়ে ও জাল স্বাক্ষরে প্রতিবেশী রজব আলী মাত্র ২৬ লাখ টাকায় শফিকুরের কাছে বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করে নেন। এরপরর ৫ জুলাই নগরীর রাজপাড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন। লিখিত অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন,
৫ জুলাই দুপুর ১টার দিকে জমিটি দখল নেয়ার জন্য শফিকুর রহমান, রজব আলী, তার ছেলে আতিকুল ইসলাম এমিল, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, মিলন ও নুরুল ইসলাম লাল হাতুড়ি-শাবল নিয়ে তার বাড়িতে গিয়ে গেট ভাঙ্গার চেষ্টা করে ও হুমকি দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি লক্ষীপুর পুলিশ বক্ষে খবর দেন। খবর পেয়ে বক্সের এটিএসআই মাহবুব গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে থানায় খবর দিলে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশ গিয়ে তাদের সরিয়ে দেওয়ার পর ওইদিন বিকেল ৪টার দিকে আবার তারা জোর করে বাড়িত ভেতরে প্রবেশ করে সাইনবোর্ড লাগিয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে চলে যায়। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১০ জুলাই রাজপাড়া থানার এসআই রাজিউর ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া
গেছে বলে রিপোর্ট দেয়। সেখানেও চুনিকে পাগল বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ জমি ক্রেতার দাবি, তিনি সুস্থ মানুষের কাছ থেকে জমি কিনেছেন। এরপর আগষ্ট মাসের ১৩ তারিখেও তিনি অপর একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সেখানেও তাকে হুমকি ও মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর হুমকির অভিযোগ করা হয়। এ ছাড়া আদালতেও একটি মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। পৈত্রিক সম্পতিটুকু রক্ষা করতে তারা খারিজ বন্ধেরও আবেদন করেন সহকারী কমিশনার ভূমি বরাবর।
সর্বশেষ চলতি বছরের গত জানুয়ারী মাসের ২৫ তারিখ সাড়ে ৬টার দিকে জমি ক্রেতা শফিকুর রহমান মাস্তান নিয়ে গিয়ে ভুক্তভোগী মুছা ও তার বোনকে হুমকি ধামকি দেয়। জমি ছেড়ে দেয়ার জন্য নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাপ প্রয়োগ করে। এরপর তিনি নগরীর রাজপাড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন।
এ বিষয়ে নগরীর রাজপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভুক্তভোগী গোলাম হাফিজ মুছা বলেন, আমার প্রতিবন্ধী বোনের শেষ সম্বল রক্ষা করতে গিয়ে অনেক হুমকি-ধামকি আসছে। বিষয়টি নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যাতে আমরা ন্যায্য বিচার পাই।
জমি ক্রেতা নাটোরের সোনালী ব্যাংক অফিসার শফিকুর রহমান তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি জাল স্বাক্ষরে জমি কিনিনি। এটা হোসনে মাহাবুবুন আক্তার চুনির স্বাক্ষর। তিনি নিজে গিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে স্বাক্ষর করেন। আমি কোন পাগলের কাছ থেকে জমি কিনিনি সুস্থ মানুষের কাছ থেকে জমি কিনেছি। তার বাড়িতে আমি হামলা করিনি। জনপ্রতিনিধি নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। জমিটি লোন করে আমি কিনেছি।
এ বিষয়ে রজব আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার কাছে আসলে সব কাগজ দেখানো হবে। তার বোনও আমার কাছে আছে। আদালত কি বিষয়টি জানে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জানানোর প্রয়োজন না হলে জানিয়ে লাভ কী? প্রয়োজন হলে জানানো হবে। স্বাক্ষর জাল করা হয়নি। হোসনে মাহাবুবুন আক্তার চুনি পাগল না। স্বেচ্ছায় সে আদালতে গিয়ে জমি রেজিস্ট্রি দিয়েছে।
শফিকুর ও রজবের বক্তব্য নেয়ার পর খবর ২৪ ঘন্টার এই প্রতিবেদক কাছে আতিকুল ইসলাম এমিল নামের ৮ নং ওয়ার্ডের সাবেক যুবলীগের সভাপতি পরিচয় দিয়ে বলেন, আপনি মাটি সংক্রান্ত বিষয়ে দুইজনকে কল দিয়েছেন। অভিযোগের কাগজসহ সন্ধ্যার পরে দেখা করবো। ক্ষমতাসীন দলের জেলার সাবেক এক নেতার নাম করে বলেন তার সামনে বসে কথা বলবো। আপনি কল দেন কিসের বলে? আমার বাবাকে কল দেন কিসের বলে ? আমার সম্পর্কে আগে খোঁজ নেন এমিল কে? হুমকির সুরে কথাগুলো বলেন। পরে বলেন, কাগজ নিয়ে আপনার সাথে দেখা হবে।
জেএন