খবর২৪ঘন্টা নিউজ ডেস্ক: ২০১৭ সালে মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যের রাথিদংয়ের খ্যায়াদং এলাকায় যখন রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলছিল তখন জাহেদ হোসেনের বয়স মাত্র ১০ বছর। সেখানে সে পড়তো দ্বিতীয় শ্রেণিতে।
একদিন হঠাৎ করে তাদের পাড়ায় সেনাবাহিনী আক্রমণ করলে প্রাণ বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দেয় তার ছয় বছর বয়সী ছোট ভাই কামাল হোসেন। সেখানেই কামালের মৃত্যু হয়। এটিই ছিল ছোট ভাইয়ের সঙ্গে জাহেদের শেষ স্মৃতি। এর পর জীবন বাঁচাতে মা-বাবার সঙ্গে জাহেদও পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। সেই জাহেদের ঠিকানা এখন টেকনাফের শামলাপুরের ২৩ নম্বর রোহিঙ্গা শিবির।
শুধু জাহেদ নয়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সেই ট্র্যাজেডি বা রোহিঙ্গা ঢলের আজ ৩ বছর পূর্তি হলো। এর আগেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন বহু রোহিঙ্গা। সবমিলিয়ে বর্তমানে কক্সবাজারের ৩৪টি অস্থায়ী শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গার সংখ্যা কমপক্ষে ১২ লাখ।
এসব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। সমস্যার তিন বছর পার হলেও এখনো পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেননি। প্রত্যাবাসনের জন্য গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ দফায় দফায় বৈঠকে বসছে, অব্যাহত রয়েছে কূটনৈতিক তৎপরতাও। বৈঠক বা কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকলে কী হবে ফেরার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহ এবং মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। ফলে ঝুলে গেছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। এমন পরিস্থিতিতে নিজ দেশে ফেরা নিয়ে সংশয় কাটছে না রোহিঙ্গাদের।
তাদের দাবি, নাগরিকত্ব, নিজ ভিটে বাড়ি ফেরত, জাতিসংঘ ফোর্সের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত, রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারসহ সব দাবি মেনে নেওয়ার পাশাপাশি অধিকার ফিরিয়ে দিলেই মিয়ানমারে ফিরে যাবে তারা।
তিন বছরেও রোহিঙ্গারা ভুলতে পারেনি সেই সহিংসতা
টেকনাফের বাহারছড়ার ২৩ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের বি-১ ব্লকে মায়ের সঙ্গে বসবাস করে সেই জাহেদ হোসেন। তার মা আমিনা খাতুন (৩৫) বলেন, মিয়ানমারে মগদের তাড়া খেয়ে চোখের সামনে পানিতে পড়ে মারা গেছে আমার ছয় বছরের শিশু কামাল হোসেন। সেই স্মৃতি কীভাবে ভুলি?
‘সেখান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পরও রাতে চিৎকার দিয়ে মারতে আসছে, কাটতে আসছে বলে ঘুম থেকে উঠে যেত জাহেদ। এখন সে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে’, যোগ করেন আমিনা।
কুতুপালং-১ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা বৃদ্ধ সোলাইমান বলেন, শুধু একবার দুইবার নয়, দফায় দফায় আমরা সেখানে (মিয়ানমারে) নির্যাতনের শিকার হয়েছি। রাস্তায় বের হতে পারতাম না, বাজারে যাওয়া যেত না। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করতো রোহিঙ্গাদের জীবন যাত্রা। মরার আগেও এ নির্যাতনের কথা ভুলব না।
ফিরে যাওয়ার বিষয়ে সোলাইমান বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে থাকতেই সব কিছুর সমাধান করতে চাই। আবার যেন ফিরে আসতে না হয়, সেজন্য সব অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হলেই আমরা সেখানে ফিরে যাব। এর আগে নয়। ’
রোহিঙ্গা নেতা মো. সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ২৫ আগস্ট এ দিনটি আমাদের জন্য একটি কালো দিন। এ রকম দিন আর কোনো রোহিঙ্গার জীবনে না আসুক আমরা সেটাই চাই। তাই আমাদের এবারের দাবি থাকবে সব অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন।
তিনি আরও বলেন, তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এবছর আমরা বড় কোনো সমাবেশ করবো না। ঘরে বসেই আমরা আমাদের দাবি আদায়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।
এই রোহিঙ্গা নেতা আরও বলেন, এটি আমাদের দেশ নয়। আমরা এ দেশে থাকতেও চাই না। আমরা আমাদের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে চাই। সেটা অবশ্যই নাগরিকত্ব, রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিচার, ক্ষতিপূরণ, সম অধিকারসহ সব অধিকার নিয়েই। আমরা টেকসই প্রত্যাবাসন চাই। মিয়ানমার সরকার ১৩৫ জাতিকে সেদেশে মেনে নিয়েছে। আমরাও সেই ১৩৫ জাতির সঙ্গে বসবাস করতে চাই। আমরা চাই, আমাদের সব দাবি পূরণ করা হোক এবং অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
‘মিয়ানমারে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এ সরকারের প্রতি আমাদের লাখ লাখ শুকরিয়া’, যোগ করেন মোস্তফা।
এই রোহিঙ্গা নেতা আরও বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার অতীতে অনেকবার রোহিঙ্গাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রতারণা করেছে। আমরা আর প্রতারিত হতে চাই না। সব দাবি-দাওয়া এবং নিরাপত্তাসহ নিজ দেশে ফিরতে চাই। মিয়ানমারে আরও ১৩৫ জাতি যেভাবে বসবাস করে সেভাবে আমরাও অধিকার এবং মর্যাদা নিয়ে সেখানে বেঁচে থাকতে চাই। ’
বাংলাদেশে যেভাবে রোহিঙ্গা আসা শুরু
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। ১৯৭৮ সালে ২ লাখ ৩৩ হাজার এবং ১৯৯১ সালে আড়াই লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ছাড়া বাকিদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হলেও ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই থেকে প্রত্যাবাসন বন্ধ হয়ে যায়। এখন প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বইছে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ভেস্তে যাচ্ছে। গতবছর ২২ আগস্ট ও আগের বছরে দফায় দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
সেই ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস উখিয়া-টেকনাফে
রোহিঙ্গা ঢলের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির এখন উখিয়ার মেঘা ক্যাম্প। শুধু উখিয়া নয়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফের বনাঞ্চল এবং পাহাড়ি এলাকায় এসব রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘভুক্ত এবং দেশি-বিদেশি অন্তত ১৩০টি সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদাগুলোর যোগান দিচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা চরম অস্বস্তিতে রয়েছে। প্রথমদিকে স্থানীয়রা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও এতদিনেও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হওয়ায় দিন দিন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে কেন্দ্র করে ইয়াবা পাচারকারী, সন্ত্রাসী ও মানবপাচারকারীসহ সমাজবিরোধী চক্রের নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেছে। ফলে দিন দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।
এ বিষয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, উখিয়া-টেকনাফে এখন স্থানীয়রা সংখ্যালঘু। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শিগগির শুরু না হলে এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনদিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এমনকি রোহিঙ্গাদের নিয়ে বর্তমানে স্থানীয়দের চরম হতাশা তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা দিনদিন প্রকট হয়ে ওঠছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক তৎপরতা জোরদার এবং সরকারকে বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। অন্যথায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আশা করা যাবে না।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের মানবিকতা দেখিয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর থাকা-থাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে সরকার। তবে সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে প্রত্যাবাসন। সরকারও চায় যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হউক এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য সরকার সচেষ্ট আছে।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সরকার চায় যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে। তবে বর্তমানে করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী সব কর্মকাণ্ড স্থিমিত হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরকার প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের প্রক্রিয়া আবার শুরু করবে।
খবর২৪ঘন্টা/নই