মাদকের ভয়াবহ ছোবলে জর্জরিত রাজশাহী জেলা ও মহানগর এলাকায় বছরের বারো মাসেই ঘটা করেই অভিযান চালায় পুলিশ, বিজিবি, ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা। প্রায়ই রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে চৌকি ফেলে তল্লাশি করা হয়। এসব দৃশ্য দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে রাজশাহীতে মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার হয়েছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিটা ঠিক তার উল্টো।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মূল দায়িত্ব মাদক নিয়ন্ত্রণ হলেও বাস্তবে রাজশাহী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একক কোন মাদকবিরোধী অভিযান নেই বললেই চলে।
জানা গেছে, প্রায় বেশ কয়েক বছর আগের একটি তালিকাকে পুঁজি করেই বিভিন্ন সংস্থা এসব অভিযান পরিচালনা করায়। কিন্তু মাদক চোরাচালানে যুক্ত নতুন নতুন মাদক ব্যবসায়ীরা সবার চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। আবার বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীদের নাম বাদ দিয়েই তালিকা মাঝে মাঝে হালনাগাদ করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কয়েকটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এসব অভিযান করা হয়ে থাকে। অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্যই থাকে মাদক ব্যবসায়ীদের অভিযানের অগ্রীম ইঙ্গিত দিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল এসব অভিযানে আটক বা জব্দ হওয়া হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিল আটকের পর গায়েব করে দিয়ে পুনরায় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া।
আরএকটি উদ্দেশ্য হল নকল হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের বোতলে পানি ভরে নকল মাদক দিয়ে মামলা দেখানো যাতে সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ জনসাধারণ মনে করতে পারে মাদকবিরোধী অভিযান সফল হচ্ছে। আটক বা জব্দ মাদকের সঙ্গে আটক ব্যক্তির (অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাহক বা কামলা) স্বীকারোক্তির কথা বলে বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীদের ফোন করে জানানো যে, ”আটক ব্যক্তি জানিয়েছে যে সে আটক মালের মালিক এবং পরবর্তীতে জব্দ মাদকের মালিক হিসেবে তাকে পলাতক আসামি করা হবে”।
এক্ষেত্রে নাম বাদ দেয়ার জন্য হাঁকা হয় বিপুল অঙ্কের টাকা। টাকা না দিলে পলাতক আসামি করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড় মাদক ব্যবসায়ীরা টাকা দিয়ে পুলিশের সঙ্গে সমঝোতা করে। এক্ষেত্রে পুলিশ আটক ব্যক্তির সঙ্গে জব্দ করা হেরোইন বদল করে নকল হেরোইন দিয়ে আদালতে নমুনা পাঠায়। ফলে কেমিক্যাল পরীক্ষায় আটক মাদক নকল বলে প্রমাণিত হয়। এতে মাদকের মামলাটিতে আটক ব্যক্তিরও কোনো শাস্তি হয় না।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, হেরোইন চোরাচালানের আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ব্যবহার হচ্ছে গোদাগাড়ী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লালগোলায় রয়েছে হেরোইন তৈরির কারখানা। সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভয়ঙ্কর মাদক হেরোইন আসছে গোদাগাড়ীতে। গোদাগাড়ীতে হেরোইন ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছে চার শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে শতাধিক মাদক সম্রাট কোটি কোটি টাকার হেরোইন এনে দেশের ভেতরে পাচার করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রয়েছে ২৫৩ জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা। এ তালিকায় থাকা অধিকাংশ মাদক সম্রাট কখনোই ধরা পড়েনি।
মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের নীতি জিরো টলারেন্স। তবুও সক্রিয় হয়ে উঠেছে রাজশাহীর সীমান্ত এলাকার চোরা কারবারি ও মাদক ব্যবসায়ীরা। পুলিশী তৎপরতায় চুনোপুঁটিরা ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতা। সীমান্ত পথ দিয়ে আসছে মাদকের বড় বড় চালান। নিত্যদিন ভারত থেকে আসছে কোটি কোটি টাকার হেরোইন,ফেন্সিডিল,গাঁজাসহ বিভিন্ন নামি-দামি ব্র্যান্ডের মদ। এগুলো অবৈধ পথে নিয়ে এসে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে গোদাগাড়ী, সাহেবনগর, মানিকচক, কোদালকাটি, আলাতুলি বগচর, হাকিমপুর, সুইজগেট, কামারপাড়া, সুলতানগঞ্জ, সারাংপুর, ভগবন্তপুর, হাটপাড়া, বারুইপাড়া, রেলবাজার, মাদারপুর, মাটিকাটা, সিএন্ডবি আঁচুয়া, গড়ের মাঠ, রেলগেট বাইপাস, বিদিরপুর, প্রেমতলী, ফরাদপুর, রাজাবাড়ী, খরচাকা, নির্মলচর,
পবা উপজেলার সোনাইকান্দি, গহমাবোনা, জাহাজঘাটি, হরিপুর, হাড়পুর। চারঘাট উপজেলার ইউসুপপুর, মুক্তারপুর, গোপালপুর, টাংগন, পিরোজপুর, রওথা এবং বাঘার মীরগঞ্জ, হরিরামপুর ও আলাইপুর চর মাজার দিয়ার সীমান্ত ব্যবহৃত হচ্ছে। চারঘাটের মাদক কারবারি আসাদুল পিতা, ইয়াদুল্লাহ, কহিনুর (৩৫) স্বামী, ইমরান, লালন পিতা লাবান , মোবারক (৩৮) পিতা খলিল, উজ্জ্বল (৩২) পিতা কাফি, টুটুল (২৭) পিতা. সফি নিযামুল (৪০) পিতা শোয়েব, জুয়েল পিতা আলাউদ্দিন, রসিদ পিতা. আব্বাস এরা সবাই চারঘাটের সিমান্তবর্তী ইউসুফপুর ইউপির মুক্তারপুর গ্রামের মাদকের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে । এছাড়াও শীর্ষ হিরোইন ব্যবসায়ী চারঘাট উপজেলার শলুয়া ইউপির চামটার কালু, মুক্তার, মেম্বার আশরাফ, ও গ্রাম শিবপুর এলাকায় শুভ। চারঘাট থানায় এদের সকলের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
এসব সীমান্ত এলাকা দিয়ে ফেন্সিডিল, মদ ও গাঁজা আসলেও গোদাগাড়ী সীমান্ত পথগুলো দিয়ে বেশীরভাগ হেরোইন প্রবেশ করে। হেরোইনের বড় চালান আসার পর সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ভাগবাটোয়ারা হয়ে অভিনব কৌশলে তা পাচার করা হয়। হেরোইন বহনে নারী ও শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। গোদাগাড়ী সীমান্তে শুধু হেরোইন পাচারের সঙ্গে ৫ শতাধিক চোরাচালানি জড়িত রয়েছে। এরা অল্প সময়ের ব্যবধানে বনে গেছেন কোটিপতি। হেরোইনের খনিখ্যাত গোদাগাড়ীতে পাইকারি ছাড়াও খুচরাভাবে হেরোইন বিক্রি হয়। হেরোইন ও ফেন্সিডিলের সঙ্গে জড়িত মাদক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা নিরাপদে চালিয়ে যেতে পুলিশ ও সরকারী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন সখ্যতা।
পুলিশের অদৃশ্য মদদে মাদক কারবারিরা বেশি সক্রিয় বলে জানা গেছে। মাসিক মাসোহারা নেওয়ার কারণে মুলহোতারা থাকেন ধরা ছোঁয়ার অনেক বাহিরে। পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণে মাঝে মাঝে চুনোপুঁটিসহ কিছু মাদক কারবারিকে আটক করে থানা পুলিশ। যা জনগণকে আইওয়াশ মাত্র। গোদাগাড়ী সীমান্তের মাদকের বড় বড় চালান দেশের বিভিন্ন স্থানে আটক করা হলেও সেই চালানগুলি ধরতে ব্যর্থ রাজশাহী জেলা ও মহানগর পুলিশ।
এবিষয়ে গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ”ওসি সাহেব সাক্ষী দিতে ছুটিতে আছে। তদন্তের জন্য বাহিরে রয়েছি। একটু ব্যস্ত আছি। আমি এবিষয়ে পরে কথা বলবো”।
এবিষয়ে চারঘাট মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে থানা পুলিশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।
এবিষয়ে রাজশাহী জেলা পুলিশের মিডিয়া ও মুখপাত্র (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) ইফতেখায়ের আলমকে একাধিকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করলে তিনিও ফোন কেটে দেন।
এবিষয়ে, রাজশাহী মহানগর পুলিশের মিডিয়া ও মুখপাত্র রুহুল কুদ্দুসের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ”আমি মিটিংয়ে আছি” বলে ফোন কেটে দেন। তাই তাদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
khobor24ghonta.com এর বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।
জেএন