নিজস্ব প্রতিনিধি: রাজশাহীতে মহিলা দলের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নগরীর প্রায় ৪০০ জন নারীর নাম, পরিচয় ও মোবাইল নম্বর প্রতারক চক্রের হাতে চলে গেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ফরিদা ইয়াসমিন নামে খোদ মহানগর মহিলা দলেরই এক নেত্রী প্রতারিত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরএমপির চন্দ্রিমা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি।
ফরিদা ইয়াসমিন নগরীর নামোভদ্রা জামালপুর এলাকার মৃত খোরশেদ আলমের মেয়ে এবং মহানগর মহিলা দলের জয়েন্ট সেক্রেটারি। লিখিত অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘গত ১১ জানুয়ারি জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের মহানগর শাখার সভাপতি ও সেক্রেটারি ওয়ার্ডভিত্তিক ১০ জন করে মোবাইল নম্বরসহ নামে তালিকা দিতে বলেন। আমি আমার ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের ১০ জনের দিয়েছি। সমাজেসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রত্যেক নারীকে ৯ হাজার টাকার করে ত্রাণ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। পরে ২৬ জনের ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে রেজিস্ট্রেশন ফর্মের জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ৭৫০ টাকা চাওয়া হয়। আমি বিকাশে ২৬ জনের ২০ হাজার টাকা পাঠাই। এরপর তাদের নম্বরে যোগাযোগ করে নম্বর বন্ধ পাই।’
এ বিষয়ে ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, মহিলা দলের মহানগরীর সেক্রেটারি খুকু আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘সমাজসেবা অধিদফতরের হারুন ভদ্রলোক। তুই ১০টা নাম দিয়ে দিবি। উনি খুব ভাল মানুষ।’ এরপর রশিদ নামে এক ব্যক্তি আমাকে ফোন দেয় এবং আমার এলাকায় দুঃস্থ, গরিব ও অসহায় কেমন আছে জানতে চায়। আমি বলি অনেকেই আছে। ফোনে সে বলে, প্যাকেট অনেক আছে। ১০টা বাদেও যদি মনে করেন, আরও নাম দিতে পারেন। যেহেতু মহানগর সেক্রেটারি ভাল মানুষ বলেছে, তাই আরও নাম দিয়েছি। হারুন আমাকে কামরুজ্জামান নামে এক স্যারের নাম্বার দেয় এবং বলে, আমার কাছে ফরম নাই, স্যারকে ফরম ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। উনি হেড অফিসে আছে, রাজশাহী আসার সময় ফরম নিয়ে আসবে। এরপর আমাকে বলা হয়, একটা ফরমের দাম সাড়ে ৭০০ টাকা। আমি প্রথমে টাকা দিতে চাইনি। তারা বলে, আপনার টেনশন নাই।
ফরিদা ইয়াসমিন আরও বলেন, মাত্র সাড়ে ৭০০ টাকা ব্যয়ে ৯ হাজার টাকার প্যাকেজ এটা তো ভাল ব্যাপার। ওরা বিকাশে টাকা দিতে বলে। যেহেতু আমাদের মহানগরীর সেক্রেটারি চিনে, সেহেতু ২৬ জনের মোট ২০ হাজার টাকা বিকাশে দিই কামরুজ্জামানের নাম্বারে। হোয়াটসএ্যাপে সাজ্জাদুল ইসলাম লেখা ছিল। টাকা পাঠানোর পর ওই নাম্বারে ফোন দিয়ে বন্ধ পাই। ঘটনার পরে ফোন দিই মহানগরীর সভাপতি ও সেক্রেটারিকে। তারা আমাকে এত অপমান করেছে, আমি নাকি মিথ্যা কথা বলছি। আমাকেই অপমান করেছে। সে (সেক্রেটারি) নাম্বার দিয়েছে বিধায় এটা করেছি।
ফরিদা ইয়াসমিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঘটনার পর থেকেই খুকুকে (মহানগরী সেক্রেটারি) ফোন দিচ্ছি। কিন্তু ফোন ধরে না। অনেক পরে ধরে মিটিংয়ে আছে বলে ফোন কেটে দেয়। আমি যে এতবড় বিপদে পড়লাম, সে যে আমার নেত্রী সে আমাকে হেল্প করবে, সান্তনা দিবে; না তো উল্টো আজেবাজে কথা বলে থেকে গেল! তাদের ওপর কিভাবে ভরসা করবো? আরও অনেকে ঠকেছে, কিন্তু প্রকাশ করেনি। সভাপতি-সেক্রেটারি উনারা নাম্বার দিয়েছে, উনাদের ধরলে উনারা বলতে পারবেন। অন্য ওয়ার্ডের ইনফরমেশন পেয়েছি, সব স্টেটমেন্ট আছে। আমি মিথ্যাবাদি নই। আমি বিপদে পড়েছি; ওরা আমাকে একটা ফোন দেয়নি, এটা আমার চরম অভিমান। এটা ১০০% প্রতারণা। বোকামি করেছি উনাদের বিশ্বাস করে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর মহিলা দলের এক নেত্রী বলেন, রাজশাহী মহানগরীর প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির নির্দেশক্রমে নাম তালিকা দেওয়া হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের ৩০টা ওয়ার্ড, কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ৩৭টি ওয়ার্ড। সব ওয়ার্ডের সভাপতি ও সেক্রেটারির নাম-নাম্বার দেওয়া হয়। কে না বিশ্বাস করবে যে সাড়ে ৭০০টাকা দিয়ে ৯ হাজার টাকার প্যাকেজ পাবো; যেহেতু প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি বলেছে, ভাল লোক, ভদ্রলোক, তারা তোমাদের অনুদান দেবে সমাজসেবা অধিদফতর থেকে। আপাদেরকে বিশ্বাস করে ভুলটা করে ফেলেছে। না বুঝার কারণে, সচেতনতার অভাবে নারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
মহিলা দলের ওই নেত্রী আরও বলেন, ৩৭টি ওয়ার্ডের প্রায় ৪০০ জনের নাম ফোন নাম্বারসহ চলে গেছে। যেকোনো সময় যে কেউ প্রতারণার খপ্পরে পড়তে পারে। আমরা সুরাহা চাই। টাকাটা কোথায় গেল, কার মাধ্যমে আমাদের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি অনুদানগুলো দিতে চাইলো? আমাদের নেতারাই সচেতন হতে পারেনি; দলের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি যদি সচেতন না হয়, তাহলে কর্মীরা কীভাবে সচেতন হবে? কর্মীরা ভুল করে ফেলছে। আমরা এটার সুষ্ঠ তদন্ত চাই। আমাদের অসহায় বোনগুলো বিপদগ্রস্থের মধ্যে পড়েছে, এটার সমাধান চাই। বলা হয়েছিল, ৯ হাজার টাকার প্যাকেজ। সেখানে ৩০ কেজি চাল, ৫ লিটার তেল, একটা ভাল কম্বল, চিনি এবং নগদ ৪ হাজার টাকা দিবে। এই ৯ হাজার টাকার প্যাকেজের জন্য সাড়ে ৭০০ টাকা ফরমের দাম বলা হয়েছে। গরিব মানুষ ভুলটা করেছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সখিনা খাতুন খুকুর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে রাজশাহী মহানগর মহিলা দলের সভাপতি এডভোকেট রওশন আরা পপি বলেন, আমার চেম্বারে এসে একজন যুবদলের পরিচয় দেয় এবং নাম্বার নিয়ে যায়। পরে আননোন (অপরিচিত) নাম্বার থেকে ফোন আসলো। নাম্বার কোথায় পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুবদলের ছেলের কাছে কালেকশন করেছি। কী বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা পরিচয় দেন এবং বলেন, ‘আমরা কম্বল দেব, তালিকা দেন।’ সেজন্য আমি নাম দিতে বলেছি। কিন্তু আমরা তো আমরা টাকা দিতে বলিনি। ওই মেয়ে আমাদের নোটিশ ছাড়া টাকা দিয়েছ। চরম শিক্ষা হলো।
আরএমপির চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিয়ার রহমান বলেন, ঘটনাটি শুনছি এবং থানায় অভিযোগ নিয়েছি। আসলে গরিব মেয়েরা টাকা দিয়েছে। কিন্তু টাকার দায় তো নেত্রীরা কেউ নিচ্ছে না। ঘটনাটির তদন্ত চলছে। বিষয়টি আমরা দেখছি।
জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদফতর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক (যুগ্মসচিব) সৈয়দ মোস্তাক হাসান বলেন, রাজশাহী হলে প্রথম শুনলাম। বছরখানেক আগে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের এডি সাহেব বোয়ালিয়া থানায় গিয়ে জিডি করেছিলেন। চাঁপাইনবাগঞ্জের শিবগঞ্জে এরকম ঘটনা শুনেছি। ওখানকার অফিসার টের পাওয়ার পর সবাইকে সতর্ক করেছেন। ফলে আর কিছু হয় নাই।
তিনি বলেন, মানুষেরও অতি লোভ আছে। এসব শোনার পর আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। কিন্তু লোভে পড়ে তারা যখন এগুলা করে, করার পর তারা এগুলো প্রকাশ করে। তার আগে পর্যন্ত তারা আমাদেরকেও কিছু বলে না। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, মানুষকে বিভ্রান্ত করা কঠিন আমি মনে করি। বেশি লোভে ঘটনাগুলো ঘটে। যদি এরকম কিছু হয়ে থাকে, থানায় আমরা জিডি করে রাখতে পারি।
নই