নাটোর প্রতিনিধিঃ মৌচাকে মৌয়ালের হানা! তবে এ মৌচাক সে মৌচাক নয়। মৌয়ালও সে মৌয়াল নয়। নাটোর শহরের মানুষের মুখে মুখে রটে যাওয়া মৌচাকে মৌয়ালের হানা দেয়ার গল্পটা হল-চড়া দামে মিষ্টি বিক্রি করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া নাটোরের মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারে এবার হানা দিয়েছে ভ্যাট প্রশাসন। বছরের পর বছর ভ্যাট ছাড়া আকাশচুম্বী দামে মিষ্টি বিক্রি করে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া দোকানটিতে চলতি মাসের ২৩ তারিখ থেকে ভ্যাট প্রশাসনের দুইজন সিপাহী ও এবং একজন ইন্সপেকটর সবসময় নিযুক্ত রয়েছেন। তারা তদারকি করছেন প্রতিষ্ঠানটি কত টাকার মিষ্টি বিক্রি করছে প্রতিদিন।
নাটোরে দাপটের সাথে মিষ্টি বিক্রি করা প্রতিষ্ঠান মৌচাকের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই রয়েছে। কিন্ত আকাশচুম্বী দামের কারণে এ দোকানটির মিষ্টি কিনে খাবার সামর্থ্য সকলের নেই। শহরের অনান্য দোকানগুলোতে বহুকষ্টে ৮/১০ পদের মিষ্টি পাওয়া গেলেও মৌচাকে মেলে ৪১ পদের বাহারী মিষ্টি।
সম্প্রতি নাটোর জজ কোর্টের জুনিয়র এ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম মৌচাক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অশোভন আচরণ ও টাকার রশিদ না দেয়ার জন্য লিখিত অভিযোগ করেন জেলা প্রশাসক বরাবর। এছাড়াও মৌচাক মিষ্টির দোকানের নামে নানা রকম অভিযোগ উঠেছে।
উত্তর চৌকির পাড় মহল্লা কালুর মোড় থেকে পূর্ব দিকে পায়ে হাঁটা পথ প্রায় ৫০ ধাপ গেলেই রাস্তার উত্তর পাশে মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারের কারখানা। সুবিশাল লোহার গেট দক্ষিণে রাজবাড়ির বেড়চৌকি। তিন পাশ জুড়ে রয়েছে মানুষের বসতি। কারখানার ভিতরে প্রবেশ করতে দেখা গেল উড়ছে মাছি। ছানা থেকে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ঢাকনা ছাড়াই রাখা আছে মিষ্টি ভর্তি কড়াই। মাথায় ক্যাপ ছাড়াই শ্রমিক করছে কাজ। অপরিচ্ছন্ন স্থানে রাখা আছে মিষ্টির কাজে ব্যবহৃত সসপেন, প্লেট, কড়াই। এক লাইনে প্রায় ১৫টা উনুন জ¦লছে।
কারখানাতে কর্মরত কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা চলে এই কারখানা। দিনে ১৬ জন এবং রাতে ১৭ জন শ্রমিক কাজ করে। তবে মৌচাক কর্তৃপক্ষের দেওয়া শ্রমিক সংখ্যা ও বাস্তবিক চিত্রে অনেক তারতম্য রয়েছে।
মিষ্টি তৈরির কারিগর রিয়াজ জানান, মাথায় ক্যাপ পড়লে গরম লাগে তাই খুলে রেখেছি। তবে মালিক সকল কারিগরকে ক্যাপ দিয়েছে এবং কাজের সময় ক্যাপ ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে।
উত্তর চৌকিরপাড় কালুর মোড় এলাকার আবুল বাসার জানান, মৌচাক কারখানায় প্রায় ১২টা চুলা আছে যার সঠিক ভাবে ধোঁয়া নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। আর তার বাড়িতে ধোঁয়ার কারনে টিনের চাল সহ গাছ পালার ক্ষতি হচ্ছে। শব্দ দুষণের ফলে ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ার সমস্যা হয়। উচ্চস্বরে গান, শ্রমিকদের চিল্লাচিল্লি, বাসনপত্রের শব্দে রাতে তাদের ঘুমাতে সমস্যা হয়। তাই কারখানাটি দ্রুত স্থানান্তরের জন্য প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
লিলি বেগম নামের অপর একজন অভিযোগ করেন, তার বাড়ির সাথে লাগানো কারখানা কাজ করা শ্রমিকরা দিনের বেলায় তাদের পারিবারিক কথা শুনতে পায় ও প্রতিউত্তর করে।
মৌচাক কারখানার এই অভিযোগের বিষয়টি এর আগে গড়ায় বিচার শালিশ পর্যন্ত। শালিসে মধ্যস্থতাকারী আইনজীবী এ্যাড. মালেক শেখ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, উভয়পক্ষের শুনানি শেষে রায় দেওয়া হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ সম্পর্কে কারখানা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয় যেন এ ধরনের অভিযোগ এলাকাবাসী আর যাতে না করে।
এরকম বিভিন্ন অভিযোগ ও ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে এলাকাবাসীর মধ্যে। তবে কেউ প্রকাশ্যে কোন রকম প্রতিবাদ করেনি। তাদেরও অভিযোগ, মৌচাক কর্তৃপেক্ষর নাকি অনেক ক্ষমতা। নাটোরের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের নাম করে চলে তারা।
নাটোর রাজবাড়ির বেড়চৌকি ও পুকুর লিজার তৈয়ব আলী খান জানান, বেড়চৌকির উত্তর পাশে মৌচাক মিষ্টি কারখানা তাদের দূর্গন্ধময় বর্জ্য দিঘীর পানিতে ফেলে। ফলে প্রায় প্রতিদিন পুকুরের মাছ মরে ভাসতে দেখা যায়। কারখানা কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ করলে তারা কিছুদিন দিঘীতে পানি নিষ্কাশন বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু বর্তমানে রাস্তার নিচ দিয়ে পাইপ লাইনে আবার পানি ফেলছে। তিনি এ ব্যপারে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে দোকানের ম্যানেজার মনির হোসেন বলেন স্থানীয় এমপি সাহেব আমাদের প্রতিষ্ঠানের কাঁচাগোল্লা নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রীর জন্য। আমাদের নামে সকল অভিযোগ বানোয়াট। গভীর রাতে শব্দদূষণ হয় এই কথার সত্যতা স্বীকার করে তিনি জানান, এলাকাবাসী এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছিল। তার পরে কারখানার শ্রমিকদের নিষেধ করা হয়েছে তারা যেন কোন রকম শব্দ না করে।
আবাসিক এলাকায় কারখানা তৈরির বিষয়ে বিসিক শিল্প নগরীর উপ-ব্যবস্থাপক দিলরুবা দিপ্তি জানান, বিসিক শিল্প নগরী কোন আবাসিক এলাকায় কারখানা তৈরির অনুমোদন দেয় না। বি.এস.টি.আই অথবা পরিবেশ অধিদপ্তর আবাসিক এলাকায় কারখানা তৈরির অনুমোদন দিয়েছে কিনা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।
নাটোর কাস্টমস্ অফিসের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো: আব্দুল লতিফ জানান, মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ আগে থেকই ছিল। এজন্য উদ্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশে চলতি মাসের ২৩ তারিখ থেকে মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারে ভ্যাট প্রশাসনের দুইজন সিপাহী ও এবং একজন ইনস্পেকটরকে নিযুক্ত করা হয়েছে যাতে করে তারা আর কর ফাঁকি দিতে না পারে। এই কার্যক্রম মৌচাক দিয়ে শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে শহরের সব বড় বড় দোকান গুলোতে যারা সরকারের ভ্যাট ফাঁকি দেয় তাদের প্রতি নজর রাখা হবে।
এদিকে গতকাল থেকে মৌচাকে কাস্টমস্ অফিসের ভ্যাট অভিযানের ফলে দেখা যায় ক্রেতাদের থেকে ভ্যাট আদায় শুরু হয়েছে। সোমাবার সন্ধ্যায় দোকানটিতে গিয়ে দেখা যায় এমদাদুল হক নামের ভ্যাট প্রশাসনের একজন সৈনিক পদমর্যাদার কর্মকর্তা বিক্রিত মিষ্টির দামের নেবার সাথে সাথেই ভ্যাটের পরিমাণ হিসেব করে আলাদা করছেন। ফলে, যে কাাঁচাগোল্লা এতদিন বিক্রি হত চারশত টাকা প্রতি কেজি, ভ্যাটসহ এখন ক্রেতাকে গুনতে হচেছ চারশত ষাট টাকা ।
এব্যাপারে এক জন ক্রেতার সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ক্রেতা ভ্যাট দিয়ে পণ্য কেনার তার আগে কর্তৃপক্ষকে ঠিক করে দিতে হবে দামের বিষয়টি। মৌচাক সহ সব দোকান গুলো যে লাভ করছে ভ্যাট ছাড়াই, তারা কি সরকারকে ভ্যাট দিচ্ছে। ভ্যাট প্রয়োগ করলে কাাঁচাগোল্লা সহ অন্যান্য মিষ্টির দাম আগের অবস্থানে নেওয়া হোক।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ