নজরুল ইসলাম ইসলাম জুলু : বিগত কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি’র) ত্যাগী, অভিজ্ঞ ও নির্যাতিত নেতাকে ‘গুরুত্বহীন’ পদ দিয়ে অবমূল্যায়নের অভিযোগ উঠে আসছে।
বিগত সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতাকর্মীদের ‘ভূমিকা’ মূল্যায়ন না করে যারা মামলা-হামলার শিকার হননি, যারা নির্যাতিত হননি– এমন নেতাদের দেওয়া হয়েছে পদোন্নতি। এতে ক্ষোভ ও অসন্তোষ ক্রমাগত দানা বেধেছে দলটির ত্যাগী নেতাকর্মীদের ভেতরে।
ফলে দিন দিন বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপির মাঠের চিত্র। যারা স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠে ছিলেন না, মামলা-হামলা কিংবা নির্যাতনের মুখেও ছিলেন না, যাদের ঘরছাড়াও হতে হয়নি, যারা বিগত দিনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে লিয়াজোঁ করে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন, তাল মিলিয়ে চলেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তারাই ৫ই আগষ্টে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বনে গেছেন বিএনপির দাপুটে ‘হর্তাকর্তা’।
৫ই আগষ্টের পটপরিবর্তনের পর পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের নেতাকর্মীদের একসময়ের ডান হাত, বডিগার্ড ও অনুরাগী হিসেবে পরিচিত পাড়া-মহল্লার, অলি-গলির কিশোর গ্যাং হোতা, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এখন নব্য বিএনপি নেতাকর্মী পরিচয় ধারণ করে বিএনপি’র সুসময়ে উড়ে এসে জুড়ে বসা ‘হাইব্রিড’ নেতাদের সাথে যুক্ত হয়েছে।
যারা কখনোই বিএনপিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না, যারা স্বৈরাচার সরকারের অত্যাচার, গুম, খুন, হামলা, মামলার শিকার হোন নি বরং বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন তারাই এখন বিএনপি’র দাপুটে নেতাকর্মী পরিচয় দিয়ে মূলত নানা জায়গায় দখলপূর্ব নেতৃত্ব নিয়ে এখন তৃণমূলের ত্যাগীদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। এক সময়ে যারা হামলা, মামলা, অত্যাচারের ভয়ে কোনো দলীয় সভা, মিছিলে অংশগ্রহণে ভয় পেতো। বিএনপির সভা সমাবেশ এবং বিভিন্ন কর্মসূচী এড়িয়ে চলতো। আজকে সে সমস্ত সুবিধাবাদী বিএনপির নেতাকর্মীদের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে দলীয় কার্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন সড়ক, পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে ছেয়ে গেছে। এতদিন যারা বিএনপির কার্যালয় ও নেতাদের বাসাবাড়িতে ছায়াও মাড়াননি ৫আগষ্টের পর হুট করেই বিএনপির নেতাকর্মীদের বাসাবাড়ি কিংবা অফিসে পদচারণা বেড়েছে। এখন বিএনপির ‘দুধের মাছিরা’ বিএনপির কার্যালয় ও নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত অফিস ও বাসাবাড়িতে প্রতিদিন বিভিন্ন লবিং-তদবির নিয়ে ভনভন করছেন। অন্যদিকে, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে যেসব নেতাকর্মী রাজপথে ছিলেন, মামলা-হামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন, নিহত ও গুম হয়েছেন তাদের পরিবার এখন ‘অসহায়’।
হাইব্রিড নেতাদের চাপে তাদের অনেকেই এখন দলীয় কার্যালয় এবং নেতাদের বাসাবাড়ি এড়িয়ে চলছেন। অহেতুক মিথ্যা অভিযোগে বহিষ্কার আতঙ্ক আর অবমূল্যায়নের কষ্টে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন অনেকে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করা ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী। ওই দলটির নেতাকর্মীরা এখন খোলস পরিবর্তন করে বিএনপিতে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে দলের নেতাকর্মীকে সতর্ক করা হয়েছে।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, ওয়ান-ইলেভেন থেকে শুরু করে আওয়ামী সরকারের আমলে সীমাহীন নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে থেকেছেন। অনেকে গুম, খুন হয়েছেন, অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। দলের এমন কোনো নেতাকর্মী নেই, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। অনেকের বিরুদ্ধে মামলার তিন সেঞ্চুরিও পার হয়েছে বিগত দিনে। এসব মামলায় সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে তাদের। অনেকের সহায়-সম্পদ দখল করা হয়েছে, অনেককে ঘরবাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে। তবে যেসব নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করেছেন, তারা ছিলেন বহাল তবিয়তে। ওই সময়ে তারা নিজেদের মতো করে ব্যবসা করেছেন, নিরাপদে থেকেছেন। কোনো নির্যাতন তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তারা সব সময়ই বিভিন্ন লবিং-তদবিরে পদ বাগিয়েছেন। আর এখন দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই দলের সামনের সারিতে চলে এসেছেন।
এটা শুধু বিএনপির নেতাকর্মীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। দল-সমর্থিত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যেও বিস্তার করেছে। সাংবাদিক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক থেকে শুরু করে অন্যান্য পেশার মধ্যেও দৌরাত্ম্য বেড়েছে বিগত দিনের নিষ্ক্রিয়দের। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে একসময় পুরো দলকে এর চরম খেসারত দিতে হবে বলে শঙ্কিত বিএনপির নেতারা। ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতাকর্মীদের দাবী আওয়ামী লীগের অনেক সুবিধাভোগী খোলস পরিবর্তন করে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বিভিন্ন কায়দা-কানুন করে দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে আখের গোছানোর চেষ্টা করছেন তারা।
এসব সুবিধাভোগী নেতাকর্মীই দেশের বিভিন্ন জায়গায় অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন এবং বিএনপির সুনাম ক্ষুন্ন করছেন। চতুর প্রকৃতির হাইব্রিড নেতারা সুযোগ বুঝে সটকে পড়লেও ধরা খাচ্ছেন বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মী। যাদের অপকর্মের দায়ে বহিষ্কার হতে হচ্ছে। দলের খারাপ সময়ে যারা বুক পেতে দিয়েছিল, যারা গুলি খেয়েছে, বাড়ি ছাড়া হয়েছে, যে সমস্ত নেতাকর্মী হত্যা, গুম ও পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন তারা বা তাদের পরিবার এখন চরমভাবে অবহেলিত। বিএনপির ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতাকর্মীদের দাবী ৫ই আগষ্টের পর যখন বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা বিজয় উৎসব নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন, পলাতক জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তখনই আওয়ামী লীগ থেকে সুবিধা পাওয়া অনুপ্রবেশকারীরা সুকৌশলে বিএনপি পরিচয়ে বিভিন্ন স্থানে দখল, অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটায়।
আবার, আর একটি পক্ষ এই সব অপকর্মের দায়ভার বিএনপি’র নেতাকর্মীর ওপর চাপিয়ে ‘ব্লেইম গেইম’ শুরু করেছে। সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও দেখা গেছে একই চিত্র। রাজশাহী বিএনপির রাজনীতিতেও দেখা যাচ্ছে হাইব্রিডদের দাপট। বিএনপির অভিযোগ একটি ‘বিশেষ রাজনৈতিক দল’ সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিএনপিতে অনুপ্রবেশকারী সুবিধাভোগীরাও দখল বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও সে বিশেষ দলটির বিভিন্ন কৌশলের কাছে পিছিয়ে ধীরে ধীরে কোণ ঠাসা হয়ে পড়েছে। বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন না করা, হাইব্রিডদের ছড়ী ঘোড়ানো, অহেতুক বহিষ্কার আতঙ্কে বিএনপিতে দেখা দিচ্ছে বিশৃঙ্খলা। বিভিন্ন
সূত্রে জানা যায়, বিএনপি সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড নেতারা নিজেদের দল ভারী করার জন্য পাড়া-মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ক্যাডার হিসেবে কাজ করা চিহ্নিত সন্ত্রাসী, কিশোর গ্যাং, ছিনতাইকারী, ও মাদক ব্যবসায়ীদের দলে ভিড়িয়েছেন। শুধু তাই নয় একসময়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকা কিশোর গ্যাং হোতা, মাদক ব্যবসায়ী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী পরিচয়ে রাজশাহীর বিভিন্ন থানায় আনাগোনা দেখাও গেছে। সম্প্রতি রাজশাহী মহানগরীর কয়েকটি থানায় রাজনৈতিক দলের পরিচয় নামধারী ব্যক্তিদের চা-নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করতে দেখা গেছে সে থানার অফিসার ইনচার্জকে। বিগত ১৬ বছরে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের তাবেদারি ও জুলাই-আগষ্টের আন্দোলনে বেপরোয়াভাবে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করায় ৫ই আগষ্টে জনরোষের মুখে পড়ে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী থেকে বলা হয়েছিল তারা ‘রাজনৈতিক খোলস’ থেকে মুক্তি চান।
সাধারণ মানুষ আশা করেছিলেন জুলাই-আগষ্টের বিপ্লব পরবর্তী সময়ে পুলিশ এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পুরোনো খোলসের পরিবর্তন ঘটবে কিন্তু, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। কোনো পক্ষই এখনো তাদের পুরোনো খোলস ছেড়ে বের হতে পারছেন না।
বিএ..